মাসুম হোসেন-
‘’রোগ গোপন করলে রোগীর মৃত্যু অবধারিত। শুরুতেই যদি আমি সমস্যা এবং লক্ষণগুলো চিকিৎসককে খুলে বলতাম তাহলে হয়তো চিকিৎসার মাধ্যমে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতাম। আমাকে আজ শয্যাশায়ী হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে হতো না।‘’ ভেজা চোখে আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন ৬০ বছর বয়সী রুমেল আশরাফ শিপলু (ছদ্মনাম)।
তার স্ত্রী নার্গিস আক্তার (ছদ্মনাম) দিনরাত মরণাপন্ন স্বামীর সেবা করে যাচ্ছেন।
শিপলুর বাড়িতে তার মা, ভাই-বোনসহ চার পরিবারের বসবাস। কিন্তু মা আর ভাই ছাড়া কেউ জানেন না কী তার অসুখ। ঘৃণা, আতঙ্ক আর সামাজিক নিগ্রহের ভয়ে শিপলুর পরিবার তার অসুখের কথা গোপন রেখেছেন। যক্ষ্মা, কিডনি, হার্ট, রক্তশূন্যতা, হাড়ের ক্ষয়রোগের অন্তরালে চলছে তার এইডসের চিকিৎসা।
বগুড়া পৌরসভা এলাকার বাসিন্দা শিপলু। শহরে ছিল তার একটি ফাউন্ড্রি (কৃষি যন্ত্রাংশ) ওয়ার্কশপ। লাখ লাখ টাকার ব্যবসা ছিল তার। সুখেই চলছিলো সংসার। কিন্তু তাতে বাগড়া দেয় মরণব্যাধি এইডস। আজ তার ব্যবসা নেই, নেই ওষুধ কেনার সামর্থ্যও। গার্মেন্টসকর্মী ছেলের সামান্য উপার্জনে ধুকে ধুকে চলছে তার ছয় সদস্যের পরিবার। আর শিপলু গুণছেন মৃত্যুর প্রহর।
২০১৬ শিপলু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোনো ওষুধেই সুস্থ হচ্ছিলেন না তিনি। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর প্রাইভেট ক্লিনিক পপুলারে চিকিৎসা চলে তার। এসময় দ্রুত ওজন কমতে থাকে শিপলুর। দেখা দেয় তার বগলের নিচে পাথর। এই সময় পপুলারের ডাক্তারের পরামর্শে পুনরায় মেডিকেলে ভর্তি হন তিনি। সেখানে ধরা পড়ে যক্ষ্মা। যক্ষ্মার চিকিৎসা শেষ হওয়ার আগেই গলব্লাডারের পাথর অপারেশন করার জন্য ঢাকায় যান তিনি। এর মধ্যেই শরীরের ওজন ৯০ কেজি থেকে কমে ৪৫ কেজিতে আসে। বার বার রক্তশূন্য হয়ে পড়ছিলো তার শরীর।
২০১৯ সালে স্ত্রী নার্গিস তাকে নিয়ে শজিমেকের এআর/এইচটিসি বিভাগে নিয়ে গেলে এইডস ধরা পড়ে। তারপর চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
নার্গিস বলেন, চিকিৎসক তাকে বলেছেন আপনাদের বাড়ির কাছেই চিকিৎসাসেবা। আর আপনারা এসেছেন একদম মরার আগে! এতদিনে শিপলুর শরীরের এইচআইভি ভাইরাস পরিণত হয়েছে এইডস রোগে। রোগী যতদিন শুধু এইচআইভি পজিটিভ থাকেন ততদিন চিকিৎসায় তিনি থাকেন পরিপূর্ণ সুস্থ। কিন্তু যখন তা এইডস এ রূপান্তরিত হয়ে যায় তখন আর রোগীকে চিকিৎসায় বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। তিনি আরও বলেন, তবু চলতে থাকে শিপলুর চিকিৎসা। এরইমধ্যে ২০২০ সালের জুন মাসে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান শিপলু। সেই থেকে শয্যাশায়ী তিনি। এখন তার বিছানায় পাশ ফেরার শক্তিটুকুও নেই। বাঁচতে চান শিপলু। দুই চোখে অবিরত অশ্রুর ধারা নিয়ে মরণাপন্ন এই ব্যক্তি বলেন, আমি শুধু একটু হাঁটতে চাই। হেঁটে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতে চাই। আল্লাহ পাক যদি আমাকে এইটুকু ক্ষমতাও দিতেন!
কয়েক বছর ধরে স্বামীর সেবা করে আসছেন নার্গিস। শজিমেকে চিকিৎসা নেয়া বেশিরভাগ রোগীর স্ত্রী এ রোগে আক্রান্ত হলেও নার্গিস এখনও আক্রান্ত হননি। স্বামীর সাথে স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন কাটালেও তিনি এখন অসুস্থ হননি তার কারণ সতর্কতা। নার্গিস জানান, ২০০৬ সালে ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত হন তিনি। চিকিৎসক তাকে জানিয়েছিলেন, সুরক্ষা পদ্ধতি ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক করলে তার থেকে স্বামীরও ডায়াবেটিস হবে। তাই স্বামীকে ডায়াবেটিস থেকে রক্ষা করতে তিনি কখনও সুরক্ষা ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক করেননি। স্বামীকে রোগমুক্ত রাখার তার এই চেষ্টাই তাকে বাঁচায় আরেকটি প্রাণঘাতি ব্যাধি থেকে। এইচআইভি পজিটিভ স্বামীর সাথে দীর্ঘকাল বসবাস করেও তিনি এইচআইভি পজিটিভ হননি।
তিনি আরও বলেন, ডায়াবেটিস একটি অনিরাময়যোগ্য অসুখ। আমি চাইনি আমার মতো আমার স্বামীও সেই অসুখে আক্রান্ত হোক। কিন্তু কী ভাগ্য আমাদের, স্বামী আরো বড় অনিরাময়যোগ্য অসুখে আক্রান্ত হলেন।
শয্যাশায়ী স্বামীর দিনরাত সেবার পাশাপাশি যোগান মানসিক প্রেরণাও। নার্গিস বলেন, কী করবো, স্বামীকে কোথায় ফেলবো। মানুষের তো কত অসুখই হয়, আমার স্বামীরও এটা তেমনই একটা অসুখ। যতদিন বেঁচে আছি স্বামীর পাশে এভাবেই থাকতে চাই। তিনি (স্বামী) দীর্ঘজীবী হোন।
শিপলুর চিকিৎসায় সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে পরিবার। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। শুরুতে কিছু এনজিও তাদেরকে ভাতা দিলেও বর্তমানে তারা কোন আর্থিক সহায়তাও পাচ্ছেন না। এইডসের ওষুধ সরকার বিনামূল্য দিলেও শরীরে বাসাবাঁধা অন্যান্য রোগের চিকিৎসা করতে পারছেন না তারা।
এই দম্পতি বলেন, যদি সরকার কিংবা কোন এনজিও আমাদের পাশে দাঁড়াতো তাহলে আমরা স্বস্তিতে থাকতাম। সংসারই তো চলে না এখন, এত রোগের চিকিৎসা কীভাবে করবো, পথ্য কীভাবে কিনবো?
শজিমেক হাসপাতালের চর্ম ও যৌন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডক্টর ছাইদুর রহমানকে প্রধান করে ৮ জন জনবল নিয়ে ২০১৯ সালে শজিমেকে চালু হয় এইচটিসি/এআরটি সেন্টার। উত্তরবঙ্গের ১৬ জেলার রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন এই সেন্টারে।
জানতে চাইলে ডক্টর ছাইদুর রহমান বলেন, শজিমেকের চর্ম ও যৌন বিভাগে এইডসের চিকিৎসা সেবা শুরু হয়েছে সেটা অনেকেই জানেন না। এখানে বিনামূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ ওষুধ দেওয়া হয়। সময়মতো চিকিৎসা নিলে এইচআইভি নিয়ন্ত্রণে থাকে। রোগী সারাজীবন সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকেন।
সর্বসাধারণের জন্য তিনি বলেন, জ্বর, ডায়রিয়া না সারলে এবং যক্ষ্মা হলে তাকে অবশ্যই এইচআইভি পরীক্ষা করানো উচিত। সেইসাথে কোন যৌনকর্মীর সাথে মেলামেশা করলে এবং রক্ত নিলেও নিজের রক্ত পরীক্ষা করে দেখা উচিত যে তিনি পজিটিভ হয়েছেন কিনা। তাহলে রোগটা আর ছড়িয়ে যেতে পারবে না।