কুতুব মিনার – আটশ বছরের বিস্ময়
Previous
Next
মোস্তফা খালেদ অভি –
কুতুব মিনার তৈরী হওয়া শুরু হয় ১১৯২ সালে। দিল্লির চার জন শাসকের হাতে দক্ষিণ দিল্লির মেহরৌলিতে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছিল ইট ও লাল বেলেপাথরের তৈরি এই মিনার। পুরো পাঁচ তলা নির্মানে সময় লেগেছিল প্রায় ১৯৩ বছর। বিস্তারিত বললে বলা যায়, কুতুব মিনারের নির্মাণকাজ শুরু করেন দিল্লির শাসক কুতুবউদ্দিন আইবেক। তিনি চৌহান রাজা পৃথ্বিরাজকে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজিত করে দিল্লি অধিকার করে প্রথম মুসলিম শাসনের সূচনা উপলক্ষ্যে বিজয়স্তম্ভ নির্মান শুরু করেন। কেবল এর নিচ তলা নির্মিত হতে হতেই তিনি মারা যান। এরপর দিল্লীর সালতানাতে আসে তার মেয়ের জামাই আর উত্তরাধিকারী ইলতুৎমিস। তিনি আরো কয়েক তলা নির্মাণ করেন। পরে ফিরোজ শাহ তুঘলক তৈরি করেন এর পঞ্চম ও সর্বশেষ তলাটি। কুতুবউদ্দিন আইবক থেকে ফিরোজ শাহ তুঘলক পর্যন্ত দুইশ বছরের ব্যবধানে এর স্থাপত্য রীতিতে যে পরিবর্তন সেটা ধাপে ধাপে একেক তলার নির্মানে স্পষ্ট বোঝা যায়। তা ছাড়া এর নির্মাণপদ্ধতি ও নির্মানে ব্যবহৃত কাচামালের ভিন্নতা স্পষ্ট দেখা যায় একেক তলায়। কুতুব মিনারের উচ্চতা ২৩৮ ফুট। রেড স্টোন আর মার্বেল পাথরের ব্যবহার এই মিনার সৌন্দর্যকে করেছে অতুলনীয়।
কুতুবমিনারের আশে-পাশে আরও বেশ কিছু প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় স্থাপনা ও ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যা একত্রে কুতুব কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে নয়শ বছরের পুরোনো একটি মসজিদ। মসজিদের ঠিক বাইরেই বারান্দার বিভিন্ন পাথরের স্তম্ভে খোদাই করা রয়েছে হাজার বছরের পুরোনো পদ্ম, শঙ্খ, ঘণ্টা, চতুর্ভুজ। রয়েছে, জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তিও। এছাড়া কুতুব মিনার চত্বরে অবস্থিত চতুর্থ (মতান্তরে পঞ্চম) শতকের লৌহস্তম্ভও আকর্ষণ ও বিস্ময়ের এক বিষয়। গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের (বিক্রমাদিত্য) সময়ে প্রায় ২৪ ফুট উঁচু ওই স্তম্ভটি নির্মিত হয়েছিল হলে ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন।
১৫০৫ সালে, একটি ভূমিকম্পে কুতুব মিনার বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়; এটি মেরামত করেছিলেন দ্বিতীয় লোদি সুলতান সিকান্দার লোদি ।
পরবর্তীতে, ১৮০৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর একটি বড় ভূমিকম্পে আবার মারাত্মক ক্ষতি হয়। ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর রবার্ট স্মিথ ১৮২৮ সালে টাওয়ারটি সংস্কার করেন।
কুতুবমিনারের নামকরণ নিয়ে বিতর্ক আছে। ভারতের প্রথম মুসলমান শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেকের নামে নাকি প্রখ্যাত সুফি কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে এটা মিমাংসিত না। সাধারণ লোক ধারনা এটা যে টাওয়ারটির নামকরণ করা হয়েছে কুতুবুদ্দিন আইবকের নামে , যিনি এটি শুরু করেছিলেন। কিন্তু সম্ভাবনা বেশি যে এটি কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর নামে নামকরণ করা হয়েছে, কারণ কুতুবমিনারের নির্মাতা সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ তাঁর একান্ত অনুগত ভক্ত ছিলেন। পুরো কমপ্লেক্সটি ভারতীয় উপমহাদেশে টিকে থাকা প্রাচীনতম নিদর্শনগুলির মধ্যে একটি।
সারাদিন ক্লাস ল্যাব ওয়ার্ক শেষে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেট্রো করে কুতুব মিনার পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো। মিনার চত্বরে দেখলাম দূর হতে আসা টুরিস্টরা ছবি তুলছে, লোকাল প্রেমিক-প্রেমিকারা হাতে হাত ধরে হাঁটছে, বাচ্চারা লাফাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে, আর তাদের মা বাবাদের গ্রুপ ঘরোয়া আলাপে মশগুল। পাশেই বিমানবন্দর। কিছুক্ষন পর পর বিমান আসা যাওয়া করে। রাতের দশটা পর্যন্ত মিনার কমপ্লেক্স খোলা থাকে। বের হবার আগে ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে চার দিকে একবার তাকালাম।
পুরান রাজা যায়, নতুন রাজা আসে। নতুন রাজা আবার পুরোনো হয়। রাজতন্ত্র একসময় ইতিহাস হয়ে, উপনিবেশন পেরিয়ে আসে প্রজাতন্ত্র। তবুও তার সাথে নয়শত শীতকাল ধরে ঠায় দাড়িয়ে থাকে এই পুরানো দিল্লির এই মিনার কমপ্লেক্স।
মোস্তফা খালেদ অভি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ এবং জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা বিভাগে মাস্টার্সের ছাত্র