ক্ষণিকের বিতর্ক ও চিরায়ত কাজীদা
তানভীর সিরাজ অন্তু –
“যখন থামবে কোলাহল, ঘুমে নিঝুম চারিদিক”
মহাপরাক্রমশালী মুঘল সম্রাট আকবর। সমগ্র ভারতে একাধিপত্য বিস্তারের জন্য দিগ্বিজয়ে নেমেছেন, দখল হচ্ছে একের পর এক রাজ্য। এরমধ্যেই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো রাজস্থানের এক যুবক, মহারানা প্রতাপ সিংহ। সবার প্রিয় রানা। নির্ভীক যোদ্ধা, যে মার খায়, কিন্তু পরাজিত হয় না। কাজী আনোয়ার হোসেন সেই বীরকেই আধুনিক রূপ দিয়ে বানালেন মেজর রানা। বন্ধু গীতিকার মাসুদ করিমের মাসুদ নামটা জুড়ে দিলেন রানা নামের সাথে। মেজর মাসুদ রানা হয়ে দাঁড়ালো বাংলা সাহিত্যের প্রথম বাঙালি গুপ্তচর চরিত্র।
“অগ্নিপুরুষ”কে বেশিরভাগ পাঠকই রানা সিরিজের শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে মানে। এ.জে. কুইনেলের “ম্যান অন ফায়ার”-এর বাংলা রূপান্তর হলো অগ্নিপুরুষ। উপন্যাসটা যে কাজী আনোয়ার হোসেনের খুব প্রিয় ছিল তা বুঝা যায় সেবা থেকেই এর দুটো প্রকাশনা বের করায়। একটা হুমায়ুন আহমেদকে দিয়ে করানো “অমানুষ” আরেকটা শেখ আবদুল হাকিমের সাথে নিজের যৌথ প্রকল্প হিসেবে করা “অগ্নিপুরুষ”। দুটোই পড়েছেন এমন পাঠক মাত্রই বলবেন, অগ্নিপুরুষ অমানুষের চেয়ে যোজন ব্যবধানে এগিয়ে। একটা থ্রিলার বই পড়ার সময় মানুষের ভেতর অনেক ধরণের উত্তেজনাই কাজ করতে পারে, কিন্তু চোখের কোণে পানি আসাটা একটু অস্বাভাবিকই বোধ হয়। কাজী আনোয়ার হোসেন পাঠককে দিয়ে সেই অস্বাভাবিক কাজটাই করিয়েছিলেন কিশোরী লুবনার চরিত্র দিয়ে, বিশেষ করে রানাকে শোনানো তার সেই গানটা দিয়ে।
বইয়ের কিছু অংশ হুবুহু তুলে দিচ্ছি এখানে,
ভোরের আলো ফুটছে। বারান্দায় একা একটা চেয়ারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে রানা। সবচেয়ে বড় তারাটা মিটমিট করছে দেখে চমকে উঠল ও। নিচের বাগান থেকে ফুলের গন্ধ এসে ঢুকল নাকে। বসন্তকাল, দূরে কোথাও একটা কোকিল ডেকে উঠল। তারপর, হঠাৎ ফুরফুরে বাতাস এসে লুটিয়ে পড়ল গায়ে।
সেই গানটা বেজে উঠল অন্তরে।
এক সময় থেমে যাবে সমস্ত কোলাহল, ঘুমিয়ে পড়বে ধরণী। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা মিটমিট করলে বুঝবে আমি তোমায় ডাকছি। সে-রাতে তুমি জেগে থেকো, বন্ধু, ঘুমিয়ে পড়ো না। আর, হ্যাঁ, ফুলের গন্ধ পেলে বুঝে নিয়ো আমি আসছি। আর যদি কোকিল ডাকে, ভেব আমি আর বেশি দূরে নেই। তারপর, হঠাৎ ফুরফুরে বাতাস এসে তোমার গায়ে লুটিয়ে পড়লে বুঝবে আমি এসেছি। সে-রাতে তুমি জেগে থেকো বন্ধু, ঘুমিয়ে পড়ো না।
উঠে দাঁড়িয়ে রেলিঙের সামনে চলে এল রানা। রেলিংটা শক্ত করে চেপে ধরল দু’হাত দিয়ে, সারা শরীর কাঁপছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে বিড়বিড় করে বলল ও, ‘জেগে আছি, আমি জেগে আছি ।’
গীতিকার মাসুদ করিম, যিনি নিজেই মাসুদ রানার মাসুদ, অগ্নিপুরুষ বইয়ের গদ্যছন্দের এই গানটাকেই তিনি বানালেন, “যখন থামবে কোলাহল…”, গাইলেন কিংবদন্তী শিল্পী রুনা লায়লা। রুনা লায়লা গাইলেও গানটা আমি যতবার শুনি, ততবারই মনে পড়ে সেই ভিনদেশী কিশোরী লুবনা আভান্তির কথা। যেন তাকেই দেখছি চোখের সামনে। কী আশ্চর্য, লুবনাকে কেউ কোনদিন দেখেনি, অথচ না দেখা লুবনাও কীভাবে চোখের সামনে চলে আসে, কীভাবে মনের গভীরে থেকে যায় আজীবন!
স্বাধীন বাংলাদেশ হবার পরে বাংলা ভাষায় যতজন লেখকই লিখেছেন, তাদের চেতনে বা অবচেতনে কাজী আনোয়ার হোসেনের ভাষারীতির খুব বড় ভূমিকা ছিল। ছোট থাকতে অত কিছু বুঝতাম না, গোগ্রাসে বই পড়তাম বা গিলতাম। কিন্তু একটু বুঝতে শুরুর পরে প্রথম খেয়াল করলাম, সেবা প্রকাশনীর বইয়ে কোন বানান ভুল নেই। বাইরে থেকে দেখলে রাস্তার পাশে ফুটপাতে কিনতে পাওয়া যায় বলে ২০/৩০ টাকা দামের নিউজপেপারে ছাপা বইটাকে অবজ্ঞার মনে হতে পারে, কিন্তু শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চার যে ব্যাপারটা সেবা ধরে রেখেছে সবসময়, সেটা অনেক দামী পত্রিকা এবং বইতেও পাইনি। ৫০ বছর ধরে শিশু কিশোররা অবচেতনেই মাথায় শুদ্ধ বানান গেঁথে নিয়েছে, যে শিশুরা আজ অনেকেই প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ।
এ তো গেলো বানানরীতি। আর ভাষারীতি? বাংলাদেশের একটা পত্রিকাও পাওয়া যাবে না যারা এই ভাষারীতিতে রিপোর্ট লিখছে না। প্রতিটা নিউজ চ্যানেলও ক্রাইম রিপোর্ট বা উত্তেজক কোন রিপোর্ট প্রকাশে বেছে নিচ্ছে সেবা প্রকাশনীর কিংবা কাজীদার তৈরি করে দেয়া সেই অদ্ভুত সম্মোহনী ভাষারীতি।
“গাড়িটা উলটে ছিল রাস্তার পাশে। জানালার ফাঁক দিয়ে শুধু একটা হাত বেরিয়ে ছিল। হাতের মুঠোটা বন্ধ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কণা গায়ে এসে বিঁধছিল ক্ষুদে বর্শার মতো। রানা অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে মুঠোবদ্ধ হাতটার দিকে। ওর সব প্রশ্নের জবাব যেন ওই হাতটার মধ্যেই লুকোনো। একদিকে কাত ঘুরতে গিয়ে মুখ দিয়ে ‘আঁ’ বেরিয়ে এলো নিজের অজান্তেই। এতটা ব্যথা পেয়েছে সেটা এতক্ষণ বুঝেনি ও।“ – এইযে বাক্য কটা লিখলাম, এটা আমারই লেখা। কিন্তু এটাই কাজীদার শেখানো সেই সম্মোহনী লিখার ধরণ। ছোট ছোট বাক্য, ছোট ছোট আবেগ, ছোট ছোট ধাক্কা। পাঠক চাইলেও উঠে যেতে পারে না। আরেকটা অদ্ভুত জিনিস আছে এই বাক্যগুলোতে। একটা দুটো বাক্য পরেপরেই বাক্যের কর্তা চলে যাচ্ছে বাক্যের শেষে। “আমি ভাত খেয়েছি” না বলে বলা হচ্ছে, “ভাত খেয়েছি আমি”। জিনিসগুলো সূক্ষ্ম, কিন্তু কাজীদা তাঁর বইগুলোতে এই অদ্ভুত জিনিসটা সৃষ্টি করে গিয়েছেন। মনের অজান্তেই বাংলাদেশে বাংলায় যারা লেখে তারা সেটা আত্মস্থ করেছে পাঁচ দশক ধরে! অন্তত আরো পাঁচটা দশক যে কাজীদার শেখানো ভাষারীতি বাংলা ভাষায় থেকে যাবে, এটুকু কোন নাক উঁচু ‘বুদ্ধিজীবী’ হয়েও অস্বীকার করার উপায় নেই। কাজীদাকে পড়ে লিখতে শেখা প্রজন্ম বাংলায় লিখবে বা নাটক-সিনেমা-খবর বানাবে অন্তত আরো পাঁচটা দশক। চেতনে বা অবচেতনে কাজীদা বেঁচে থাকবেন।
টিভি সিরিজ যারা দেখে তারা মোটামুটি সবাই “ব্রেকিং ব্যাড” দেখেছে। এক অসম্ভব মেধাবী রসায়ন গবেষক ভাগ্যের কারণে সামান্য একটা স্কুলের রসায়ন শিক্ষক হয়ে জীবন যাপন করছে। এর মধ্যেই তার জীবনে আরো বড় ধাক্কা হয়ে আসে ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার খবর। সে চিকিৎসার টাকাই বা কোথায় পাবে, আর মারা গেলে পরিবারের জন্যই বা কী রেখে যাবে? এই পরিস্থিতিতে তার দুর্দান্ত রসায়নের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে সে মাদক তৈরির কাজে জড়িয়ে পড়ে। এরপর মাদক ব্যবসার অনেক গলি-ঘুপচিতে জড়ানো, জীবনের অন্ধকার দিক, সব কিছু সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে পর্দায় এসেছে।
সে যাই হোক, এই টিভি সিরিজের নাম বলার কারণ হচ্ছে Creator of Breaking Bad লিখে গুগলে সার্চ করলে একটাই নাম পাবেন ভিন্স গিলিগান। কিন্তু Writer of Breaking Bad লিখে সার্চ দিলে আরো বেশ কিছু নাম চলে আসবে। বাংলাদেশের মানুষ এই ব্যাপারটার সাথে খোলাখুলি ভাবে পরিচিত না হওয়াতেই শেখ আবদুল হাকিমের করা ‘মাসুদ রানা’র স্বত্ব বিষয়ক মামলায় ধাক্কা খেয়েছে আরকী! থ্রিলার বই, সিনেমা বা টিভি সিরিজের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা অহরহই ঘটে। যেমন, জেমস বন্ড হচ্ছে ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সৃষ্টি। কিন্তু জেমস বন্ড চরিত্র নিয়ে অনেকেই বই লিখেছেন বা সিনেমা বানিয়েছেন। কৈশোরে প্রচুর থ্রিলার পড়ার কারণে এই ব্যাপারগুলো বেশ ভালোভাবেই জানা ছিল।
মাসুদ রানার ব্যাপারটাও ‘ওপেন সিক্রেট’। আমরা যারা পড়ি তারা বেশিরভাগই জানি যে ঘোস্ট রাইটার বা নেপথ্য লেখক দিয়ে সেবা প্রকাশনীর বই লেখানো হয়। কাজী আনোয়ার হোসেন বহু বছর আগেই ব্যাপারটা স্বীকার করেছেন। এখানে রাখঢাকের কিছু নেই। এমনকি কোন বিদেশি গল্প থেকে মাসুদ রানার কোন বইটা হয়েছে তারও একটা পূর্ণাঙ্গ তালিকা পাওয়া যায়।
সেবা বা সেগুনবাগান প্রকাশনীই বাংলাদেশের মানুষকে স্পাই থ্রিলারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে এতে কোন সন্দেহ নাই। ১৯৮০-৯০ এর দশকে সেবা প্রতি মাসে নতুন ২০-২৫ টা করে বই প্রকাশ করতো, বাংলাদেশের অন্য কোন প্রকাশনীর জন্য সেটা ছিল সুদূরতম স্বপ্ন! এত বই প্রকাশ করতে পারার কারণ, বেশিরভাগ বই ছিল বিদেশি কাহিনী অবলম্বনে, তাই কাহিনী রচনার কোন ঝামেলা ছিল না, শুধু একটা জনপ্রিয় ইংরেজি থ্রিলার বই একজন ভাড়াটে লেখক বা অনুবাদকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলা হতো মূল কাহিনী ঠিক রেখে এতে খানিক বাংলাদেশের আবহ মিশিয়ে দাও। ব্যাস, জমজমাট বাংলা থ্রিলার বই হয়ে গেলো।
তখন অনেক চাকরিজীবী লেখক ছিল সেবা প্রকাশনীর। তারা বই লিখত, অনুবাদ করতো, মাস গেলে পয়সা পেতো। বইয়ের মলাটে লেখক হিসেবে কার নাম থাকলো সেটা সেই চাকরিজীবীদের ব্যাপার ছিল না! কারখানায় প্রকৌশলী বা শ্রমিক পণ্য উৎপাদন করে, কিন্তু পণ্য বাজারজাত হয় একটা নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের নামে – অনেকটা এমন একটা ব্যাপার এটা। শেখ আবদুল হাকিম, নিয়াজ মোর্শেদ, রকিব হাসান, অনীশ দাশ অপু, রওশন জামিল, ইফতেখার আমিন – এরকম আরো প্রচুর লেখকের মাসিক চাকরি ছিল সেবা প্রকাশনীর বই লেখা (মূলত বিদেশি গল্প বাংলায় রূপান্তর করা)!
ঘোস্ট রাইটারের ধারণাটা থ্রিলার বইয়ের বাস্তব প্লট তৈরির জন্য বহু আগে থেকেই জনপ্রিয়। যেমন, নায়ক এক জায়গায় বোমা মারবে, কিন্তু লেখক তো আর বোমা তৈরির প্রক্রিয়া জানে না, সে জন্য এই অংশটা লিখে দেবে কোন সেনা কর্মকর্তা। নায়ক কোন একটা পররাষ্ট্র দপ্তরে ঢুকে যাবে গোপন তথ্যের জন্য, সেই অংশটা লিখে দেবে সেই দপ্তরের ভেতরের খবর জানা কোন লোক। এর জন্য তাদের নাম প্রকাশিত হবে না, তারা সম্মানী পাবে প্রকাশনী থেকে। আর যে নায়ক অলরেডি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে (যেমন, জেমস বন্ড, মাসুদ রানা, রবার্ট ল্যাংডন ইত্যাদি) তাকে ব্যবহার করে কাহিনী তৈরি হলে প্রকাশনীর ব্যবসা করা সহজ হয়ে যায়। শাকিব খানের নামেই যেমন বাংলাদেশের সিনেমা চলে, কে পরিচালক, কে প্রযোজক, কী কাহিনী কোনটাই গুরুত্বপূর্ণ না, ‘শাকিব খান’ নামটা গুরুত্বপূর্ণ।
শেখ আবদুল হাকিমের দাবী করা ২৬০ টা বইয়ের লেখকও কিন্তু তিনি না, তাকে সর্বোচ্চ অনুবাদক বা রূপান্তরক বলা যেতে পারে! তার উপর নায়কের নাম থেকে কাজী আনোয়ার হোসেনের তৈরি করা “মাসুদ রানা” নামটা সরিয়ে দিলেই আর কোন পাঠক পাওয়া যাবে কিনা আমি তা নিয়ে সন্দিহান। কারণ বইগুলো মৌলিক কাহিনীর না। “মাসুদ রানা” নামটাই যদি না থাকে তাহলে আমি কেন শেখ আবদুল হাকিমের বই পড়বো? আমি বরং ইয়ান ফ্লেমিং, সিডনি শেলডন, উইল স্মিথ, রবার্ট হেডলি চেজ, ড্যান ব্রাউন, ফ্রেডরিখ ফোরসাইথ এঁদের মৌলিক বই পড়বো (যদিও এঁদের নামে চালানো সব বইও হয়তো এঁদের না!)
থ্রিলার বইয়ের বেশিরভাগ পাঠক হচ্ছে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী মানুষ। এরপরে আসলে থ্রিলার বইয়ের আবেদন আর সেভাবে থাকে না। যে আমি একসময় সারাদিন (আক্ষরিক অর্থেই সারাদিন, এমনকি পাঠ্য বইয়ের চিপায় রেখে পড়তাম!) থ্রিলার বইয়ে ডুবে থাকতাম, সেই আমিই সর্বশেষ মাসুদ রানা পড়েছি সম্ভবত ৩-৪ বছর আগে। স্মার্টফোনের অত্যধিক ব্যবহারে পাঠাভ্যাস দিনে দিনে কমে গেছে, এটা একটা কারণ, তবে বয়সের আবেদনের ব্যাপারটাও আছে।
কালের পরিক্রমায় পাঠক কমে যাওয়ায় প্রকাশনা ব্যবসায় মন্দা চলছে। যে কয়জন পাঠক আছে তারাও অনেকে সিনেমা পাইরেসির মত বইয়ের পাইরেসি ‘পিডিএফ ফরম্যাট’ পড়ে। বইয়ের পাঠকদের অন্তত লেখককে সম্মানী দেয়ার মূল্যবোধ না থাকলে আর কার কাছ থেকেই বা মূল্যবোধ আশা করা যায়? পেটে ভাত না থাকলে লিখবে কে? আর প্রকাশই বা করবে কে?
নির্ভরযোগ্য সূত্র কিনা জানি না, তবে শোনা কথা হচ্ছে, কাজী আনোয়ার হোসেনের জীবদ্দশাতেই অসুস্থতার কারণে তাঁর ছেলেরা ব্যবসার হাল ধরে। তারা ভাড়াটে লেখক কিংবা স্বনামে লেখক, সবার ক্ষেত্রেই সম্মানী নিয়ে ঝামেলা পাকায়। এ কারণে বাংলাদেশের প্রবাদপুরুষ কাজী মোতাহের হোসেনের ছেলে কাজী আনোয়ার হোসেনের আমলে এ জাতীয় অভিযোগ না এলেও, এখন সেবার প্রায় সব লেখকই এজাতীয় অভিযোগ করছেন। শেখ আবদুল হাকিমের মতো মাসুদ রানার আরেক লেখক ইফতেখার আমিনও সম্ভবত মামলা করেছেন। আমার শৈশবের হিরো রকিব হাসানের ‘তিন গোয়েন্দা’ও তো আর সেবাতে নেই বেশ কয়েক বছর হলো।
বাংলাদেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটা বহুলপ্রচলিত অভিযোগ। “চেয়ারম্যান সাব নিজে যখন দেখতো তখন আমদের ঠকাতো না, তার ছেলে এখন ব্যবসা দেখে আর সব সুযোগ সুবিধায় আমাদের ঠকায়!” দুটো কোম্পানির চাকরির অভিজ্ঞতা আমার, দুটোতেই একই কথা শুনেছি। কে জানে দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যবসায়ীরা কেন কর্মীবান্ধব হন না? যুগের সাথে তাল মিলিয়ে অত্যধিক মুনাফা লোভের কারণে?
হুমায়ুন আহমেদের মতো লেখক বাসায় একটা টিভি কেনার জন্য কাজী আনোয়ার হোসেনের দ্বারস্থ হয়েছিলেন, এটা তাঁর নিজের মুখেই স্বীকার করা। একটা বই অনুবাদ করে দেয়ার পর কাজী আনোয়ার হোসেন তাকে নগদ টাকা দিয়েছিলেন। মূল বই “ম্যান অন ফায়ার”-এর হুমায়ুন আহমেদের বাংলা রূপান্তর “অমানুষ” আর মাসুদ রানায় “অগ্নিপুরুষ” দুটো বইই কিন্তু ভীষণ জনপ্রিয়। টাকা নিয়ে অভিযোগ সেবা প্রকাশনীর লেখকেরা করতো না, এমনটাই শুনে এসেছি। সেখানে এখন মামলা মোকদ্দমাও হচ্ছে!
মাসুদ রানার সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আজীবনই কাজী আনোয়ার হোসেন থাকবেন। এখানে বিতর্ক তৈরির অবকাশ নেই। বাংলা ভাষার প্রথম গুপ্তচর হিসেবে রানা টিকে আছে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। বাংলা ভাষায় কথা বলা আমাদের প্রজন্ম হয়তো গড়ে আরো ৫০-৬০ বছর বেঁচে থাকবে পৃথিবীতে। ব্যবসার লেনদেনের ব্যাপারে জানি না, তবে অন্তত এই কটা বছর মাসুদ রানা আর কাজীদা সমার্থক শব্দ হিসেবেই থাকবে আমাদের হৃদয়ে।
তানভীর সিরাজ অন্তু একজন যন্ত্রপ্রকৌশলী, গবেষক এবং লেখক।