চিরন্তন কাজীদা
এ.আর.এম. আহাম্মেদউল্লাহ রাফি –
“টেবিলের উপর পরিপাটি করে সাজানো রয়েছে ব্রেকফাস্ট। এক গ্লাস অ্যাপল জুস কয়েক ঢোক শেষ করে ঠক করে টেবিলের উপর গ্লাসটা নামিয়ে রাখলো বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সর উজ্জ্বলতম তারকা শ্রীমান মাসুদ রানা – বয়স ছাব্বিশ, উচ্চতা পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি, গায়ের রং শ্যামলা, সে বাংলায় কথা বলে….” – মনে পড়ে গেলো ‘ধ্বংস পাহাড়’-এর কথা! ষাটের দশক থেকে নিয়ে আজও বহুল পরিচিত, সর্বত্র জনপ্রিয় কালজয়ী চরিত্র মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জুলাই ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। তাঁর পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মাতা সাজেদা খাতুন। তিনি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন।
পড়াশোনা শেষ করে কাজী আনোয়ার হোসেন গান দিয়ে তার কর্মজীবনের যাত্রা শুরু করেন ! ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ঢাকা বেতারের সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। এছাড়া রেডিও কিংবা টিভিতে গান গাওয়া এবং সিনেমার প্লে-ব্যাকেও তিনি নিয়োজিত ছিলেন ওতপ্রোতভাবে ।
লেখালেখি নিয়ে পরোক্ষভাবে যাত্রা শুরু করেন ১৯৬৩ সালে! বাবার দেয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে সেগুনবাগিচায় প্রেস শুরু করেন, যা পরবর্তীকালে নাম পাল্টে হয় সেবা প্রকাশনী। এই সেবা প্রকাশনী থেকেই কুয়াশা সিরিজ, মাসুদ রানা সিরিজ এবং তিন গোয়েন্দা সিরিজ এর মত কাল্ট ক্লাসিক প্রকাশিত হয়। স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদও এই প্রকাশনীতে লিখেছেন।
কুয়াশা-১-এর মাধ্যমে লেখালেখির জগতে অভিষেক ঘটে কাজী আনোয়ার হোসেনের। তাঁর অধিকাংশ উপন্যাস ও গল্প বিদেশী কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে রচিত। মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম লেখা গুলো –‘ধ্বংস পাহাড়’, ‘ভারতনাট্যম’ এবং ‘হ্যাকার’ – ছাড়া বাকিগুলো ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের ভাবানুবাদ বা ছায়া অবলম্বনে রচিত। তার মৌলিক লেখনীগুলোও ছিলো অত্যন্ত চমকপ্রদ।
চলচ্চিত্র এবং টিভি নাটকের জগতেও ছিল তাঁর পথচলা। তাঁর রচিত মাসুদ রানার কাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় ১৯৭৪ সালে। আবার বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে প্রথম প্যাকেজ নাটক ‘প্রাচীর পেরিয়ে’-এর কাহিনী রচনা করা হয় কাজী আনোয়ার হোসেন রচিত মাসুদ রানা সিরিজের পিশাচ দ্বীপ নামক বই থেকে।
বাংলাদেশের অত্যন্ত ব্যবসা সফল এই মাসুদ রানা চরিত্র নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ২০১৯ সালের ২৯ জুলাই শেখ আব্দুল হাকিম ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ২৬০টি এবং ‘কুয়াশা’ সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে স্বত্ব বা মালিকানা দাবি করেন এবং ২০২০ সালের ১৪ জুন বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস শেখ আবদুল হাকিমের পক্ষে রায় দাওয়ার প্রেক্ষিতে তিনি মাসুদ রানার লেখকস্বত্ব হারান। যদিও কপিরাইট অফিসের এই আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন কাজী আনোয়ার হোসেন। অনেক বিতর্কের পরেও বাংলার মানুষের মনে চিরসম্মানের স্থানেই আছেন কাজী আনোয়ার হোসেন।
বাংলাদেশের স্পাই থ্রিলার সাহিত্যের এই পথিকৃৎ চিরবিদায় নিয়েছেন নিভৃতেই। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের ৩১ তারিখ তাঁর প্রোস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ে। এরপর একবার ব্রেইন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক হয়। পরবর্তীতে লাইফ সাপোর্টে থাকাকালীন ২০২২ সালের ১৯ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মৃত্যুর পরেও চিরকাল বাংলার মানুষের মনে মাসুদ রানার ছায়া হয়ে বেচেঁ থাকবেন কাজী আনোয়ার হোসেন।
এ.আর.এম. আহাম্মেদউল্লাহ রাফি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী