বাংলায় সুন্দরবন অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। সুন্দরবনে অনেক প্রজাতির গাছ থাকলেও শতকরা ৭০ ভাগ গাছ সুন্দরী। তাইতো এই গাছের নামানুসারে এই বনের নাম সুন্দরবন রাখা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। বর্তমানে সুন্দরবনের উপকূলবর্তী এলাকার পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির সাথে সাথে সুন্দরী গাছের আধিক্য অনেকটা কমে গেছে। ফারাক্কা বাঁধের পূর্বে সুন্দরবনের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জায়গায় মিষ্টি বা ঈষৎ লবণাক্ত পানি ছিল। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার পর থেকে লবণাক্ততার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে এ এলাকার প্রায় তিন চতুর্থাংশ জায়গা লবণাক্ত বা ঈষৎ লবণাক্ত।
পানির লবণাক্ততার উপর নির্ভর করে সুন্দরবনের গাছের প্রজাতি টিকে থাকে। সুন্দরবনে গাছের যে আগা মরা দেখা যায় তা লবণাক্ততার প্রভাব। পানি লবণাক্ত হওয়ার পূর্বে গাছ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল, বেশী লবণাক্ত হওয়ার জন্য গাছ ক্যামবিয়ামের মাধ্যমে খাদ্যরস এর উপরে উঠাতে পারেনা। তাই আর ঐ উচ্চতায় থাকা সম্ভব হয় না যার ফলে গাছের আগা মরে গাছ ছোট হয়ে যাচ্ছে এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির সাথে সাথে গাছের এই আগা মরা সমস্যাও চলতে থাকবে। সরেজমিনে গাছ প্রত্যক্ষ করে দেখা যায় যে, কোন ছোট গাছের আগা মরে গেছে এমনটি দেখা যাচ্ছে না। কারণ ঐখানকার লবণাক্ততায় গাছের উচ্চতা অতটুকুই থাকার কথা। আসলে আগা মরা গাছের কোন রোগ নয়, এটা মূলত লবণাক্ততার প্রভাব। সুন্দরবনকে লবণাক্ততার উপর ভিত্তি করে ৩ ভাগে ভাগ করা যায় – (১) উচ্চ লবণাক্ত এলাকা, (২) মধ্যম লবণাক্ত এলাকা এবং (৩) নিম্ন লবণাক্ত এলাকা।
উচ্চ লবণাক্ত এলাকাঃ এখানকার লবণাক্ততার পরিমাণ ২৫ থেকে ৪০ পিপিএম পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফলে এই এলাকায় লবণাক্ততা খুব বেশী। সাতক্ষীরা এলাকার সুন্দরবন উচ্চ লবণাক্ত এলাকার মধ্যে পড়ে। আবার হিরণ পয়েন্টসহ সমুদ্র উপকূল এলাকা উচ্চ লবণাক্ত এলাকার মধ্যে পড়ে। এ এলাকার গাছের মধ্যে গরান ও গেওয়ার পরিমাণ খুব বেশী। সুন্দরী গাছের পরিমাণ মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ। এছাড়া এ এলাকায় ধুন্দল গাছ দেখা যায়। খলিশা গাছ বেশী থাকার জন্য সুন্দরবনের সবচেয়ে ভাল মানের মধু (খলিশার মধু) মৌয়ালরা এখান থেকেই সংগ্রহ করেন। সাধারনভাবে এ এলাকায় গাছের গড় উচ্চতা ১৫ থেকে ২০ ফুট হয়ে থাকে। পুরো সুন্দরবনের মধ্যে ভারতের ৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের মধ্য থেকে পশ্চিম ভারতের সুন্দরবনে অধিক লবণাক্ততার কারণে গাছের উচ্চতা আরও কম হয়।
মধ্যম লবণাক্ত এলাকাঃ শিবসা আর পশুর নদীর মধ্যভাগ এবং পশুর নদীর পূর্ব পাড়ের কিছু অংশ এই এলাকার আওতায় পড়ে। এই এলাকায় পানির লবণাক্ততা ৫ থেকে ২০ পিপিএম হয়ে থাকে। মধ্যম লবণাক্ত পানির এলাকায় সুন্দরী, পশুর, বাইন, কাঁকড়া গাছের আধিক্য বেশি দেখা যায়। গাছের উচ্চতা সাধারণত ৩৫ থেকে ৪৫ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। এমন এলাকায় সুন্দরী গাছের পরিমাণ শতকরা ৫০ ভাগ।
নিম্ন লবণাক্ত এলাকাঃ সুন্দরবনের শরণখোলা এলাকা এর অন্তর্ভুক্ত। একে মিষ্টি পানির এলাকাও বলা হয়। অত্র এলাকায় পানির লবণাক্ততা কোন কোন সময় ১ থেকে ২ পিপিএম হয়ে থাকে। সুন্দরী গাছের হার ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। গাছের উচ্চতা ৭০ থেকে ৮০ ফুট। বলেশ্বর নদীর মিষ্টি পানির প্রভাবের কল্যাণে অত্র এলাকায় মিষ্টি পানি দেখা যায়। সুতরাং সুন্দরী গাছকে লবণাক্ত এলাকার গাছ না বলে মিষ্টি পানির এলাকার গাছ বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশে সুন্দরবনের অংশ রয়েছে ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার। তবে বাংলাদেশে সুন্দরবনের আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিমধ্যে হিরণ পয়েন্টের খুব নিকটে একটি চর পড়েছে এবং এতে গাছপালাও জন্মেছে। এই দ্বীপের নাম বঙ্গবন্ধুর চর। এর আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার। এই অংশ হিসেবে আসলে সুন্দরবনের আয়তন হবে ৬,০২৫ বর্গ কিলোমিটার। তবে সামুদ্রিক উপকূল চরে ৬ মিটারের কম গভীরতার জলাভূমিসহ ৬,১০২ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ইউনেস্কো ১৯৯২ সালে “রামসার সাইট” হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনের ৩ টি অভয়ারণ্যকে (সুন্দরবন পূর্ব, সুন্দরবন দক্ষিন, সুন্দরবন পশ্চিম) ৭৯৮ তম বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে। বর্তমানে অভয়ারণ্য এলাকার আয়তন বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া সুন্দরবনের আরও ৩ টি এলাকাকে ডলফিন অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলো হল (১) ঢাংমারী (২) চাঁদপাই (৩) দুধমুখী।
প্রাকৃতিক সুন্দরবনের ক্রমবিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে নতুন চর হলে তাতে কেওড়া ও ওড়া গাছ জন্মে থাকে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাইন, কাঁকড়া, গেওয়া, ইত্যাদি গাছ জন্মে থাকে এবং শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ ক্লাইম্যাক্স স্টেজে সুন্দরী গাছ জন্মে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে যে প্রজাতি আসার কথা তা বাদ দিয়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পর্যায়ের গাছ রোপণ করলে তা প্রকৃতিতে টিকে থাকবেনা বা মারা যাবে। আবার দ্বিতীয় বা তৃতীয় পর্যায়ের প্রজাতি জন্মানোর সাথে সাথে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের গাছ মারা যাবে। প্রতিটি পর্যায়ের মা গাছ না থাকলেও বীজ ভেসে এসে ঐ গাছ জন্মাবে। আবার পূর্বের পর্যায়ের মা গাছ থাকলেও ঐ বীজ থেকে আর নতুন চারা গজাবেনা।
প্রায় ১০,০০০ (দশ হাজার) বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের গাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে। এই জন্যই পৃথিবীর সর্ববৃহত্তম একক ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক বন বলা হয়।
হাওলাদার আজাদ কবীর একজন প্রকৃতিপ্রেমী লেখক। তিনি সুন্দরবনের করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।