back to top
3.9 C
New York
Friday, November 22, 2024

TMN Shop

spot_imgspot_img

বইমেলায় একটি সন্ধ্যা এবং তাহারা


আবির আর মূর্ছনার আজই প্রথম দেখা, তাও একুশের বইমেলায়…আবির আজ নীলরঙের পাঞ্জাবী পড়ে এসেছে, মূর্ছনার পরনে বাসন্তীরঙা শাড়িতে নীল আকাশের ছোয়া…ঠিক হলো দুইজন দুইজনকে তাদের বসনের রঙের মাধ্যমে চিনে নিবে। 

 

সময়টা ১৯৯৬…সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে তার বিদায়ী কিরণ ছড়াচ্ছে, তাতে লাজুক কিশোরীর গালের টোলপড়া রক্তিম আভা…এমন আলোয় ধীরপায়ে কাজলপড়া চোখে টিপশোভিত একজন সুবসনা এগিয়ে আসছে…আবির আজ তার লেখা প্রথম কবিতার বই “স্বপ্নের আভা” নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার স্বপ্নের মূর্ছনাকে উপহার দেওয়ার জন্য…

 

মূর্ছনা ঠিকই স্টল নং-১০১ এর সামনে, আবিরকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলোঃ আসসালামু আলাইকুম, আপনিই আবির চৌধুরী?

আবির (লাজ ভেঙে)ঃ জি, আপনি আমার সাথেই কথা বলছেন। আপনি নিশ্চয়ই মূর্ছনা আহমেদ?

মূর্ছনাঃ হ্যা, কেমন আছেন?

আবিরঃ এইতো বেশ ভালো। আপনি?

মূর্ছনাঃ (কপালের পাশ থেকে ওর কোমরঅব্দি লম্বা চুলগুলো সরিয়ে) জি, আমিও ভালো এখন…

আবিরের কোথাও একটু খটকা লাগলো, মেয়েটা এভাবে বললো কেন! তাহলে কি এমন কোন সমস্যা আছে তার, যা তার একান্ত ব্যক্তিগত! আচ্ছা থাক সেসব কথা! 

আজ প্রথম দেখা ওদের দুইজনের। আগে সৌজন্য কথাবার্তা বলে পরে চাইলে নিশ্চয়ই জানা যাবে, তবে মূর্ছনা যদি নিজে থেকে বলতে চায়, তবেই…

মূর্ছনাঃ আবির, আপনার কবিতার বইটা কিন্তু কয়েক কপি নিব আমি, আর অবশ্যই অটোগ্রাফ সহ… (বলেই একটু মুচকি হাসলো)

আবিরঃ জি, অবশ্যই, বলুন, কতকপি নিবেন? আমি অবশ্য চাইলে আপনাকে পাচ/ছয় কপি বই সৌজন্য কপি হিসেবেই দিতে পারি।

মূর্ছনা (প্রায় সাথে সাথেই)ঃ না, না, তা কেন! আমি দাম দিয়েই নিব। আপনি প্লিজ অটোগ্রাফ দিতে থাকুন। আমি আপাতত দশ কপি নিচ্ছি আপনার বইটা…

আবির (একই সাথে খুশি এবং অবাক হয়ে)ঃ আচ্ছা, আমি অটোগ্রাফ দিয়ে দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করতে হবে কিন্তু…

 

এরপর সবগুলো বইয়ে সম্ভাব্য পাঠকদের অটোগ্রাফ দিয়ে তবেই মূর্ছনার দিকে তাকালো। সেকি!! মেয়েটা তো গরমে একদম ঘেমে গেছে। 

 

আবিরঃ মূর্ছনা, আপনার বইয়ের কাজ শেষ, কিন্তু আপনার তো গরমে বেশ কষ্ট হচ্ছে। চলুন, আপনাকে আইসক্রিম খাওয়াচ্ছি। আর এই বইগুলো আমি আলাদা একটা ব্যাগে স্টলেই রেখে দিচ্ছি। আপনার কাজ শেষ হলে মেলা থেকে যাওয়ার সময় নিয়ে যাবেন। 

মূর্ছনাঃ আচ্ছা, ঠিক আছে। 

 

এরপর নীল পাঞ্জাবীর তরুণ কবি, একজন বাসন্তী শাড়ির তরুণীর সাথে হাটছে। আবির এতক্ষণে খেয়াল করলো, এই গরমেও মূর্ছনার গলায় আকাশী রঙের একটা ওড়না প্যাচানো। অনেকের কাছেই সেটা ফ্যাশন সচেতনতা বলে মনে হতে পারে, তবে আবিরের মনের খটকাটা আরো বেশি ঘনীভূত হলো। 

আবিরই নীরবতা ভাঙলো।

 

আবিরঃ মূর্ছনা, চলুন আইসক্রিম খাওয়া যাক। আর এইদিকটাতে আপনাকে নিয়ে আসলাম, তার কারণ সুন্দর বাতাস হচ্ছে। আপনার তো তখন গরমে কষ্ট হচ্ছিল। এখানে বসে আরাম করে হাওয়া খেতে খেতে আইসক্রিম খান, ততক্ষণে আমরা পরস্পরের সাথে আরেকটু ভালোভাবে পরিচিত হই। 

এই প্রথম আবিরের দিকে ভালোভাবে তাকালো মূর্ছনা, মাথাভর্তি চুলশোভিত শ্যামবর্ণের তরুণ, যার শ্রাবণের মেঘের মত কালো একজোড়া গভীর দৃষ্টির মোহময় চোখ, আর দীপ্তিমান হাসি…এমন একজন মানুষের দিকে তাকালে সহজেই একজন তরুণী তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারবেনা!

মূর্ছনা দেখলো আবির তাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তার মন বলছে, আবির তাকে কিছু বলতে চায়…কিন্তু কোন একটা অজানা কারণে তার বেশ অস্বস্তি হচ্ছে! 

মূর্ছনাঃ কিছু মনে করবেন না, আমি আজ বেশিক্ষণ থাকতে পারবোনা, বাসায় কিছু কাজ আছে। বোধহয় আইসক্রিম খাওয়ার পরই আমাকে চলে যেতে হবে! (তবে, আসল কথা হল, তার বাসায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ নেই, শুধুমাত্র মানসিক অস্বস্তি এড়াতেই আবিরকে এভাবে বলা…)

 

আবির মনে মনে অনেক কথা সাজাচ্ছিল, কিন্তু মূর্ছনার এসব কথায় এক ধাক্কায় তার সব উৎসাহ উড়ে গেল…

তারপরও স্বাভাবিক হয়ে, মূর্ছনাকে বললোঃ

আবিরঃ মূর্ছনা, মাত্রই তো মেলায় এলেন। কিছুক্ষণ স্টলগুলো ঘুরে যান, আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। 

 

আবিরের কথা শুনে মূর্ছনার অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল! মানুষটা কীভাবে বুঝলো যে, তার মন এখন খারাপ!! না, না, আবিরকে তার ব্যক্তিগত ব্যাপারটা কিছুতেই জানানো যাবেনা।

মূর্ছনাঃ আমি ভালো আছি, আইসক্রিম এর জন্য ধন্যবাদ।

দুজনেই এখন আইসক্রিম খাচ্ছে। 

আবিরঃ মূর্ছনা, আপনি বোধহয় বাসা থেকে খুব একটা বের হননা, তাইনা! আপনি কি জানেন, আপনি কতটা সুন্দর! আজ বইমেলায় আপনার আগমনের কারণে যেন প্রাণ ফিরে এসেছে…

 

এমন সময় একটা দমকা হাওয়ায় মূর্ছনার গলায় জড়ানো ওড়নাটা সরে গেল, আতঙ্কিত হয়ে প্রাণপণে সেটিকে আবার গলায় জড়াতে ব্যস্ত হয়ে পরলো মূর্ছনা, কিন্তু একহাতে আইসক্রিম থাকায় সেটা শেষ পর্যন্ত আর সম্ভব হলোনা। 

 

আবিরের দৃষ্টি আটকে গেল মুর্ছনার গলায়, গলার পোড়া কোচকানো চামড়ায়!! একনিমিষেই মূর্ছনার ভালো না থাকার কারণটা পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে…

 

ততক্ষণে মূর্ছনার মায়াচোখ বেয়ে অবুঝ ঝর্ণাধারা গড়িয়ে পড়ছে, দৃষ্টিতে অসীম শূন্যতা!! সেই শূন্যতা কিছু হলেও পূরণ করতে পারে তার খুব কাছের কেউ, খুব আপন কেউ… কিন্তু আবির তো এখনো আগন্তুক মূর্ছনার জীবনে…

 

আবিরঃ মূর্ছনা, প্লিজ কাদবেননা। আজ আমাদের প্রথম দেখা, এমন কিছু হবে, সত্যিই আশা করিনি! আপনাকে কাদতে দেখে আমার নিজেরই খুব খারাপ লাগছে। 

মূর্ছনা তখনো নীরব…

আবির বললোঃ গলার ওড়নাটা খুলে ফেলুন। প্রাণভরে শ্বাস নিন, আপনার ভালো লাগবে। মানুষের একজীবনে কতকিছুই তো হয়, একসময় সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। 

আবিরের কথায় কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলো মূর্ছনা, মনে সাহস পেলো, তার মানসিক অস্বস্তি দূর হলো। হয়তো আবিরকে এখন তার কষ্টের গোপন কথাগুলো জানানো যাবে, হয়ত সে সব বুঝবে। অন্য কারো মত অবজ্ঞা করবেনা তাকে…

মূর্ছনা (নিজেকে সামলে নিয়ে)ঃ আসলে, হঠাৎ বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। বাসা থেকে আজ অনেকদিন পর বের হলাম। ঠিক করেছিলাম, আপনার বইগুলো আর মাসুদ রানার থ্রিলারসমগ্র কিনে বাড়ি ফিরে যাব তাড়াতাড়িই, কিন্তু…

আবিরঃ আচ্ছা থাক, বাদ দিন। আপনি এখানেই আরাম করে বসুন। আমি স্টল থেকে আপনার বইগুলো নিয়ে আসছি। এখন তো সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আপনাকে বাড়ি পৌছে দিলে আপনার কোন আপত্তি আছে?

 

মূর্ছনা না-বোধক মাথা নেড়ে তার আপত্তি নেই জানালো।

আবির ধীরে ধীরে তার স্টলের দিকে যাচ্ছে। মূর্ছনা অবাক হয়ে আবিরের হেটে চলা দেখছে আর ভাবছে, একজন মানুষের মন সুন্দর হলে তার সবকিছু দেখতে কতই না ভালো লাগে! যেমন এখন আবিরের অবয়ব, কথা বলা, তাকানো, হাসি, হেটে চলা যেকোন কিছু দেখতেই তার মনে একটা প্রশান্তি আর শ্রদ্ধার ভাব চলে আসছে। সত্যিই সদ্য আগত ফাল্গুনের বাতাসটাও আজ এত চমৎকার ভাবে তার মনে দোলা দিচ্ছে; একটু আগে দমকা হাওয়ার কারণে তার মানসিক অস্বস্তির কথা সে প্রায় ভুলেই গেল।

 

নাহ, বইমেলা কিছুক্ষণ ঘুরে দেখবে আজ, মূর্ছনা ঠিক করলো। সে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাটা শুরু করলো। সামনেই ডানদিকে একটা স্টল নানারকম বেলুন আর রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো, দেখলেই কেমন মন সতেজ করা অনুভূতি হয়, এটা আসলে শিশু-কিশোরদের বই দিয়ে সাজানো একটা স্টল। এখানে কি কি বই পাওয়া যাচ্ছে, বেশ মনোযোগ সহকারে দেখছে মূর্ছনা। রূপকথার গল্প, শিশুতোষ কৌতুক, এডভেঞ্চার-থ্রিলার কি নেই, এই স্টলে! ঠিক করলো, রূপকথার গল্প আর এডভেঞ্চার এর বই নিবে সে, কিন্তু বইগুলো নিবে ঠিকঠাক করেও কারো জন্য একটু অপেক্ষা করলো মূর্ছনা। পেছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো আবির এদিকে আসছে কিনা…

 

আবির বই এর ব্যাগসহ যেখানে ওরা বসে আইসক্রিম খাচ্ছিল, সেখানে ক্ষণিকের জন্য থামলো, সেখানে মূর্ছনাকে না পেয়ে একটু বসলো, চারপাশটা ভালোমত একটু দেখতে গিয়েই শিশুদের একটা স্টলে দেখতে পেল মূর্ছনাকে, ততক্ষণে মূর্ছনা আনন্দে উদ্বেলিত কিশোরীর মত দুইহাত নেড়ে আবিরকে ডাকছে। আবিরের খুব ভালো লাগছে এটা ভেবে যে, কিছুক্ষণের জন্য হলেও একজন তরুণী তার জীবনের একটা ভীষণ কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়েছে, আরো অবাক হয়ে খেয়াল করলো ওর গলার ওড়নাটা এখন আর গলায় নেই, বরং সেটা এখন ওর হাতব্যাগ এর সাথে কায়দা করে জুড়ে দিয়েছে! 

 

আবির স্টলের কাছাকাছি যেতেই মূর্ছনা খুব খুশি খুশি গলায় তাকে বললোঃ আবির, আমি এই বইগুলো নেব ঠিক করেছি, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম…

 

আবির বুঝতে পারলো যে, মূর্ছনা এই বইগুলো তার কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেতে চাচ্ছে। তাই দেরী না করে বইগুলোর দাম দিয়ে মূর্ছনাকে নিয়ে স্টল থেকে বের হয়ে আসলো।

আবিরঃ কি, এবার খুশি তো? অহহ, একটা কথা ভুলে গেছেন বোধহয়, আপনি মাসুদ রানার “থ্রিলারসমগ্র” নিতে চাচ্ছিলেন। পাঠক সমাবেশ এর স্টলে এটা পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে অবশ্য আপনার পছন্দের আরো কিছু বই পেয়ে যেতে পারেন। 

মূর্ছনাঃ বাব্বাহ! একদম মুখস্থ বলে যাচ্ছেন সব, কোন বই কোন স্টলে পাওয়া যাচ্ছে! 

আবিরঃ আরে নাহ! সেরকম কিছু না, আমরা তো মোটামুটি একই সময়ে বেড়ে ওঠা মানুষ, তাই আমাদের পছন্দে কম-বেশি মিল থাকবেই, সেভাবেই আর কি! আচ্ছা ভালো কথা, স্টলটা কিন্তু একটু দূরে আছে, আপনাকে আরো খানিকক্ষণ হাটতে হবে, সমস্যা নেই তো!

মূর্ছনাঃ না, কোন অসুবিধা নেই। হাটতে আমার ভালোই লাগছে। জানেন, আজ অনেকদিন পর মুক্ত বাতাসে আকাশের নিচে হাটছি…

আবির (যোগ করলো)ঃ তাও আবার আমার মত একজন ছিন্নমূল কবির সাথে, হা হা হা…

মূর্ছনাঃ আবির, আপনিও দেখি ভালোই হেয়ালি করতে পারেন! (বলেই হেসে দিলো)

আবিরঃ মূর্ছনা, একটা কথা বলি, এখন থেকে আর মন খারাপ করবেন না; মন খারাপ হলেই জোর করে হলেও হাসবেন। প্রথম প্রথম এমনটা করতে কষ্ট হবে, কিন্তু একসময় দেখবেন হাসি আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। 

 

মূর্ছনা বেশ অবাক হলো, এভাবে তো সে কখনো ভেবে দেখেনি!

কথা বলতে বলতে তারা স্টলের সামনে পৌছে গেল। পাঠক সমাবেশ এর স্টলের ডেকোরেশন দেখে মূর্ছনার মন ভালো হয়ে গেল। স্টলের দুইপাশে পাখির ডানার মত দুটো ডানা, প্রত্যেক ডানার পাশেই স্টলের বাইরের দিকে কিছু বড় ফুলদানিতে নানারকম পাতাবাহার গাছ; আর ডানা থেকে স্টলের প্রবেশপথে একটা করে আয়না বসানো – আর আয়নার পাশেই লেখা – “বই মনের দর্পণস্বরূপ”। সত্যিই স্টলের ডেকোরেশন যে করেছে, মনে মনে তার রূচির প্রশংসা করেই ফেললো মুর্ছনা। 

 

স্টলের ভেতর ঢুকে তার মনে হল, এত বিশাল একটা দোতলা বাড়ি, তার ভেতর দুইপাশে দুটো কাঠের সিড়ি দিয়ে উপরে চলে যাওয়া যায়। দুটো তলাতেই হরেক রকম বই বিক্রি হচ্ছে – রবীন্দ্র, নজরুল, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, মানিক বন্দোপাধ্যায়, বেগম রোকেয়া, জাহানারা ইমাম আরো কত নামী-দামী সাহিত্যিকদের বইগুলো নিচতলায়; অন্যদিকে দোতলায় থ্রিলার-এডভেঞ্চার, অনুবাদের বই, রাজনৈতিক-দর্শনভিত্তিক বই এসব পাওয়া যাচ্ছে। মুর্ছনার যেটা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগলো, সেটি হলঃ স্টলের সেন্ট্রাল সাউন্ডবক্সে লো সাউন্ডে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে আর প্রত্যেক তলায় পাঠকদের একটা রিডিং কর্ণার আছে, যেখানে ছোট ছোট টেবিলে কফি/চা আর স্ন্যাক্স খেতে খেতে পাঠক তার পছন্দের বই পড়তে পারেন। 

 

আবিরের কথায় ঘোর ভাঙলো মূর্ছনার…

আবিরঃ বই কি এখানে বসেই পড়বেন? নাকি পছন্দের বই নিয়ে নেবেন তাড়াতাড়ি? 

মূর্ছনাঃ ওহ! তাই তো! ঘড়িতে তো সন্ধ্যা ৭টা বেজে ৩০ মিনিট, রওনা দিতে হবে তো! আচ্ছা আপনি রিডিং কর্নারে একটু বসুন, আমি মাসুদ রানার থ্রিলারসমগ্র বইটার পেমেন্ট করেই চলে আসছি…

 

আবির (মুর্ছনাকে অবাক করে দিয়ে)ঃ উহু, তার আর দরকার হবেনা। এই নিন আপনার গিফট আমার পক্ষ থেকে…

বলেই মোটা একটা বই মূর্ছনার দিকে এগিয়ে দিল…ওমা! এতো দেখা যাচ্ছে মাসুদ রানার বইটা…

মূর্ছনা ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল, এটা কেমন হল! সে আসলে পাঠক সমাবেশের সাজসজ্জা দেখে এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিল যে বই কেনার কথা তার মাথাতেই ছিল না।

মূর্ছনাঃ এতগুলো বই গিফট করলেন! এটা কি ঠিক হলো! আপনার এখান থেকে কোন বই পছন্দ হলে বলুন, আমি আপনাকে গিফট করছি…

আবির (হেসে দিয়ে এবং না-সূচক মাথা নেড়ে)ঃ আপনার দেরী হয়ে যাচ্ছে, চলুন বের হওয়া যাক…

 

মূর্ছনা দেখলো সত্যিই তো, ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা ৭টা বেজে ৫০ মিনিট। এখান থেকে রিকশায় করে ধানমন্ডিতে তাদের বাসায় যেতে কম করে হলেও মোটামুটি আধা ঘণ্টার মত লাগবে। 

মূর্ছনার ইচ্ছা হচ্ছে একাই রিকশা নিয়ে চলে যেতে, আবিরকে প্রথমবারের দেখাতে সে আজ বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আবিরের অনুরোধ ফিরিয়ে দিতেও ইচ্ছা করছেনা। 

মূর্ছনাঃ হ্যা চলুন।

মেলা থেকে বের হয়ে টিএসসির দিকে গিয়ে একটা রিকশা নিল তারা, গন্তব্যস্থল ধানমন্ডি-৩২। হ্যা, এখানেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি, আর তার খুব কাছেই মূর্ছনাদের বাসা। 

আবিরঃ আমি আসলে প্রথমবারের মত আমার কবিতার পাঠকের সাথে এক রিকশায় চড়লাম। এজন্য রীতিমতো রোমাঞ্চিত আমি! (মুখে একটা চওড়া হাসি ফুটে উঠলো তার)

মূর্ছনাঃ আসলে, আমার ভাইয়া জাফর আপনাকে প্রায়ই ফোন করত, ভাইয়া তো আপনার মতই নতুন লেখক, আপনারা লেখালেখি নিয়ে প্রায়ই আলাপ-আলোচনা করতেন। তখন থেকেই ইচ্ছা ছিল আপনার সাথে পরিচিত হওয়ার, তাছাড়া আপনার লেখা কিছু কবিতা আমি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার “নতুনের আবাহন” বিভাগে পড়েছিলাম। 

আবিরঃ বাহ, আপনি তাহলে আমার ভালোই খোজখবর রাখতেন!

মূর্ছনা কিছুটা লজ্জা পেল। 

মূর্ছনাঃ একদিন প্লিজ বাসায় আসুন। ভাইয়া অনেক খুশি হবে।

আবিরঃ আর, আপনি বুঝি খুব বেজাড় হবেন!

 

দুইজনেই এবার শব্দ করে হেসে ফেললো।

আবিরঃ আচ্ছা বলুনতো, কি মনে করে আমার মত অখ্যাত একজন কবির বই গুণে গুণে দশ কপি কিনে ফেললেন!

মূর্ছনা কি বলবে ঠিক ভেবে পাচ্ছেনা! আসলে আবিরকে তার ভালোলাগার কথাটাই কি বলে দেবে! না, না, প্রথম দিনেই এটা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়! সে মনে মনে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলো। 

মূর্ছনাঃ ওইযে বললাম না, আপনার লেখা কবিতাগুলো পত্রিকার পাতায় পড়তাম, আপনার লেখায় কি আছে জানিনা, পড়ে এত ভালো লাগতো! মনে হত আপনার কবিতার বই বের হলে আমার পরিচিতদের গিফট করবো, সবাই জানবে আপনার কাব্যপ্রতিভা সম্পর্কে!

 

আবিরের মনে হল, মূর্ছনা তাকে পুরোপুরি সত্যটা বলছেনা। থাক, সামনেই হয়ত আসল সত্যটা জানা যাবে…একদিনে সব নাহয় নাই জানলো। প্রিয় মানুষগুলোর মনের গোপন কথা মুখে প্রকাশের আগেই বুঝে যাওয়ার এই ব্যাপারটা অবশ্য আবিরের বেশ ছোটবেলার, এটা রীতিমতো এডভেঞ্চারাস একটা ব্যাপারও তার জন্য।

 

আবির (একটু ভালোভাবে মূর্ছনার দিকে তাকিয়ে)ঃ একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি কি?

মূর্ছনাঃ জি, বলুন। 

আবিরঃ আপনার এত বড় ক্ষতি কে/কারা করলো, যার কারণে আপনার সবসময় নিজেকে আড়াল করে চলতে হয়!!

 

মূর্ছনা এত সুন্দর সন্ধ্যায় আবার হঠাৎ এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলনা। কিন্তু জানতো, আবির কখনো না কখনো এই প্রশ্নটা করতোই। তার চেয়ে আজই বরং প্রশ্নটা করে ভালো করেছে। 

 

মূর্ছনাঃ আসলে, কষ্টের গল্প কেন যেন সবসময় বলতে ইচ্ছে হয়না! আমি আমার টিনএইজে এসিড সন্ত্রাসের স্বীকার হয়েছিলাম…

 

এই বলে খানিকক্ষণ চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। 

আবির অনেকক্ষণ আকাশের দিকে তাকায়নি। আজকের রাতের আকাশে কোথাও একবিন্দু মেঘ নেই,  বরং আকাশটা আজ যেন তারাদের বাড়িতে পরিণত হয়েছে; ঠিক তাদের মাথার ওপরের তারাটা অন্য তারাগুলোর তুলনায় বেশ বড়, আর সেটা শুধুই জ্বলজ্বল করছে। 

 

আবিরঃ আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, আপনি হয়ত আমার জানতে চাওয়ায় কষ্ট পেয়েছেন। আপনার মন ভালো করে দেওয়ার জন্য কি করতে পারি? গান শুনবেন?

মূর্ছনা (অবাক হয়ে)ঃ কে গান গাইবে!

আবিরঃ আপনার পাশে বসা অখ্যাত কবি ভদ্রলোক!

 

মূর্ছনার অবাক হওয়াতে অবাক না হয়ে আবির গলা পরিষ্কার করে দ্রুত গান ধরলোঃ

“ওরে নীল দরিয়া, আমায় দেরে দে ছাড়িয়া

বন্দী হইয়া মনুয়া পাখি হায়রে,

কান্দে রইয়া রইয়া…”

মূর্ছনাকে চূড়ান্ত অবাক করে দিয়ে সুর-তাল-লয় সব ঠিক রেখে আবির পুরো গানটাই গেয়ে ফেললো। 

মূর্ছনা হাততালি দিয়ে আবিরকে অভিনন্দন জানালো।

 

আবিরঃ আমি আসলে গায়ক নই, কিন্তু গানকে খুব ভালোবাসি। মাঝেমাঝে মনের তাগিদেই গাই। ইয়ে মূর্ছনা, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ অনেকদিন পর আপনি বাসার বাইরে বের হয়েছেন শুধু আমার বই কিনে আমাকে প্রমোট করার জন্য, এটাই বা কয়জন করে! 

মূর্ছনাঃ আবির, আপনার হাত দুটো দেবেন? ধরে রাখবো, কিছুক্ষণ পর তো বাসায় পৌছে যাব। এত সুন্দর একটা সন্ধ্যা উপহার দেওয়ার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। 

 

আবির হাত বাড়িয়ে দিলো, মূর্ছনা খুব স্বাভাবিকভাবে আবিরের হাত ধরলো, যেন তারা স্বামী-স্ত্রী! আবিরের হঠাৎ শায়লার কথা মনে পড়লো, কবি প্রেমিকের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শংকায় যে কিনা তাকে ছেড়ে গিয়ে সদ্য অতীতে পরিণত করেছে। না, না, এখন কেন শায়লার কথা ভাবছে সে! বরং ব্যক্তিত্ববান মূর্ছনার আবেশে আবিষ্ট থাকাটাই এখন শ্রেয়, আবির জানে মূর্ছনা তাকে কখনোই একা করে চলে যাবেনা…

 

এর ঠিক ২৫ বছর পর…

তাদের একমাত্র সন্তান প্রকৌশলী “নিষাদ চৌধুরীর” প্রথম প্রকাশিত গল্পসংকলন “অচিনপুরের নাও” এর প্রকাশনা উৎসবে তারা এসেছেন। দুজনেই এতক্ষণ তাদের সুখের ক্ষণের স্মৃতিচারণ করছিলেন…জীবনটা সত্যিই সুন্দর…

 

অনুষ্ঠানের অতিথিরা মোটামুটি সবাই চলে এসেছেন, বুয়েট থেকে নিষাদের বন্ধুরা এসেছে, ওর বেশ কয়েকজন স্কুলের বন্ধুও অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চলে এসেছে…কিছুক্ষণ পর মঞ্চে নিষাদের ডাক পরলো, নিষাদ তার মা এবং বাবাকে নিয়ে ধীরপায়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে…

 

ইফতেশাম বাশার (রিমি) একজন পুরপ্রকৌশলী এবং বর্তমানে বুয়েটে পিএইচডি করছেন। অধ্যাপনা এবং নিজের গবেষণার পাশাপাশি অবসরে তিনি গল্প-কবিতা ইত্যাদি লিখে থাকেন।

MD IMRAN HOSSAIN
MD IMRAN HOSSAINhttps://themetropolisnews.com/
Md. Imran Hossain, a certified SEO Fundamental, Google Analytics, and Google Ads Specialist from Bangladesh, has over five years of experience in WordPress website design, SEO, social media marketing, content creation, and YouTube SEO, with a YouTube channel with 20K subscribers.

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

3,800FansLike
300FollowersFollow
250SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles