মাসুম হোসেন –
বগুড়ায় এক স্কুলে রাখা মাধ্যমিকের সরকারি বই গায়েব হওয়ার বিষয়ে প্রধান শিক্ষককে দ্বিতীয়বার শোকজ করা হয়েছে। তবে এবার জবাব না দিয়ে আরও সময় নেন তিনি। এর আগে, বই গায়েব হওয়ার বিষয়ে থানায় জিডি করেন ওই প্রধান শিক্ষক। কিন্তু বই লুটের অভিযোগের তীর তার দিকেই। এরপরেও তার করা জিডির ওপরই নির্ভর হয়ে আছে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস।
অভিযোগ রয়েছে, স্কুলে রাখা সরকারি বইগুলো আট লাখ টাকায় বিক্রি করেন ওই প্রধান শিক্ষক।
তার নাম মির্জা দিলরুবা লাকী। তিনি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মাঝিড়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তার স্কুল থেকেই সরকারি বই গায়েব হয়।
মাঝিড়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে ৯ বছর ধরে সরকারি বই রাখা হত। সম্প্রতি ওই কক্ষে বইগুলো আর পাওয়া যাচ্ছে না। এরপরই সেগুলো গায়েব হয়েছে বলে গুঞ্জন ওঠে। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মির্জা দিলরুবা লাকী বই বিক্রির কথা স্বীকারও করেন। অথচ পরবর্তীতে তিনি নিজেই থানায় জিডি করেন বই গায়েব হওয়ার বিষয়ে।
গত ৩ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) বই গায়েবের বিষয়ে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাজাহানপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। বইগুলো তার স্কুলের এক কক্ষ থেকে হারিয়ে গেছে বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়। এমনটাই বলেন প্রধান শিক্ষক ।
কিন্তু গত ৩০ অক্টোবর (রোববার) এক ভিডিও স্বাক্ষাৎকারে প্রধান শিক্ষক মির্জা দিলরুবা লাকী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায়, বই রাখা ওই রুমটি ফাঁকা করা দরকার ছিল। আমি মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে বিষয়টি জানাই। পরে উনি (উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা) বইগুলো অন্য কোথাও স্থানান্তর করতে বলেন। সেকারণে পুরাতন কিছু নষ্ট বই বিক্রি করা হয়েছে। বইগুলো ২০১৫-২০১৬ সালের ছিল। একই সঙ্গে আমাদের অপ্রয়োজনীয় পুরোনো কিছু কাগজপত্রও বিক্রি করেছি।’
তবে থানায় জিডি করার পরপরই ভিন্ন কথা বলেন এই প্রধান শিক্ষক। ওই সময় মুঠোফোনে তিনি বলেন, ‘সরকারি বই গায়েব হওয়ার বিষয়ে আমি কিছু জানিনা। থানায় জিডি করেছি, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস তদন্ত করে বইয়ের সন্ধান করবে।’
বই গায়েব হওয়ার ঘটনায় গত ১ নভেম্বর ওই প্রধান শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়েছিল। সাতদিনের (সাত কর্মদিবস) মধ্যে তিনি জবাবও দেন। তবে তার জবাবে অসন্তোষ প্রকাশ করে শিক্ষা অফিস। পরে চলতি মাসের (নভেম্বর) মাসের মাঝামাঝি সময়ে তাকে আবারো শোকজ করা হয়। সাতদিনের মধ্যে তার কাছে জবাব চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি জবাব না দিয়ে আরও সময়ের আবেদন করেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে সাতদিন সময় দেওয়া হয়েছে বলে জানান উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাহবুবুল হোসেন।
বই গায়েবের বিষয়ে মাহবুবুল হোসেন দ্য মেট্রোপলিসকে বলেছিলেন, ‘প্রধান শিক্ষক মির্জা দিলরুবা লাকী এ বছর এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগে আমাকে জানিয়েছিলেন যে, জমিয়ে রাখা পুরোনো বইগুলো স্থানান্তর করতে হবে। পরে আমি বইগুলো নিলামে বিক্রির জন্য ইউএনও’র (তৎকালীন) সঙ্গে কথা বলি। ওই সময় ইউএনও আমাকে সিদ্ধান্ত জানাননি। এখন এসে দেখছি স্কুলের কক্ষে রাখা বইগুলো আর নেই।’
কথা হয় বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. তৌফিক আজিজের সঙ্গে। তিনি এর আগে, বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
দ্য মেট্রোপলিসকে তিনি বলেছিলেন, ‘গত জুন মাসে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা থেকে বদলি হয়ে আদমদীঘিতে এসেছি। ওই কক্ষে কতগুলো বই ছিল তার সঠিক হিসাব বলা কঠিন। তবে প্রতিবছর উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বই বিতরণ শেষে কিছু বই বেচে যায়। সেই বইগুলো মাঝিড়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে রাখা হত।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপজেলার অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চাহিদার তুলনায় বেশি বই নিত। পরে অতিরিক্ত বইগুলো তাদের কাছ থেকে ফেরত নিয়ে ওই কক্ষে রাখা হত। বই রাখার কক্ষটি অনেক বড়। সেখানে ৬৫-৭০ ভাগ অংশ জুড়ে পুরোনো বই ছিল। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের নিজস্ব গুদাম না থাকায় স্কুলের ওই কক্ষে বই রাখা হত।’
মো. তৌফিক আজিজ বলেন, ‘পুরোনো বইগুলো সরকারি অনুমতি নিয়ে নিলামে বিক্রি করা হয়। পরে বই বিক্রির টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়।’
দ্য মেট্রোপলিসকে মাঝিড়া মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আব্দুল হালিম দুদু বলেছিলেন, ‘এসএসসি পরীক্ষা প্রথম দিন (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকে সরকারি বইগুলো বিক্রি শুরু করা হয়। পরে ১২-১৫ দিনের মধ্যে সেগুলো বিক্রি করা হয়েছে। প্রতিরাতে স্কুলের ওই কক্ষ থেকে বইগুলো বের করে পিকআপে তোলা হত।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৩ থেকে শুরু করে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই বিদ্যালয়ের ওই কক্ষে বই রাখত উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই স্কুলের এক সহকারী শিক্ষক বলেন, ‘স্কুলের প্রধান শিক্ষক মির্জা দিলরুবা লাকী সরকারি বইগুলো বিক্রির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। স্কুলের ওই রুমে প্রায় দশ পিকআপ বই ছিল। সেগুলো প্রায় আট লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে মামলা করা হবে কিনা জানতে চাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মাহবুবুল হোসেন বলেন, ‘বইগুলো ওই স্কুলের জিম্মায় ছিল। সেখানে থেকে গায়েব হয়েছে। এ বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক থানায় জিডি করেন। সেই জিডির তদন্ত চলছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমাদেরই যে মামলা করতে হবে, বিষয়টি এমন না। একজন তো জিডি করেছেনই। এছাড়াও বই গায়েব হওয়ার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এবার বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে এই বিষয়ে।’
জানতে চাইলে শাজাহানপুর থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) মো. আমবার হোসেন দ্য মেট্রোপলিসকে বলেন, ‘সরকারি বইগুলো হারিয়ে গেছে, এমন জিডি করা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ (উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস) যদি এই বিষয়ে তদন্ত করে আমাদের প্রতিবেদন দেয়, তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। এছাড়াও উপজেলা মাধ্যমিক অফিস থেকে মামলা করা হলে তদন্ত করে আসল ঘটনা বের করা যাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থেকে মামলা করা হয়নি। এমনকি তাদের তদন্ত করা কোনো প্রতিবেদনও আমাদেরকে দেয়নি।’
বই গায়ের হওয়ার বিষয়ে মামলা কেন করা হচ্ছে না? জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিইও) মো. হযরত আলী দ্য মেট্রোপলিসকে বলেন, ‘এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে।’