back to top
3.7 C
New York
Friday, November 22, 2024

TMN Shop

spot_imgspot_img

মহাকাশ শিল্পঃ বৈশ্বিক পর্যালোচনা ও বাংলাদেশের সম্ভাবনা


মহাকাশ মানুষের আগ্রহ ও জল্পনা-কল্পনার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। মহাবিশ্বের গতি প্রকৃতি নিয়ে স্টিফেন হকিংয়ের লেখা শ্বাসরুদ্ধকর বই, ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবালের ইন্টারগ্যালাক্টিক সাই-ফাই, হলিউডের সিনেমা এগুলো আমাদের প্রজন্মের বেশ বড় একটা অংশকে ছোটবেলা থেকেই ভাবতে শিখিয়েছে, অবাক হতে শিখিয়েছে এই মহাকাশ নিয়ে। কিন্তু প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে থাকা একটা দেশের নাগরিক হিসেবে এই জগতটাকে আমাদের কাছে সবসময়ই কেমন যেন নিজেদের নাগালের বাইরের কিছু একটা মনে হয়। যদিও বাংলাদেশ সম্প্রতি মহাকাশে স্যাটেলাইট  বা কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানো দেশগুলোর তালিকায় নিজের নাম লিখিয়েছে, কিন্তু এই প্রযুক্তির জন্য আমরা এখনো পুরোপুরি বিদেশের উপর নির্ভরশীল। অধুনা শুরু হওয়া বাণিজ্যিক মহাকাশ-যুগে সারা পৃথিবীতে এখন তীব্র গতিতে মহাকাশ শিল্পের বিকাশ ঘটছে। তাই আমাদের মত দেশের জন্য এই কাজে মনোনিবেশ করার খুবই উপযুক্ত সময় এটা।

 

 

বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে এ পর্যন্ত দুটি মহাকাশযানের উড্ডয়ন হয়েছে। এর মধ্যে একটি এখন চালু আছে আমাদের সবার গর্বের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। এই ভূস্থির যোগাযোগ স্যাটেলাইটের (Geostationary Communication Satellite) নকশা ও নির্মাণ করেছে ফ্রেঞ্চ-ইটালিয়ান প্রতিষ্ঠান থ্যালেস-এলেনিয়া, এবং তাকে পৃথিবী থেকে কক্ষপথে নিয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সের রকেট। ইউরোপে তৈরি হয়ে সেখান থেকে উত্তর আমেরিকা হয়ে এটি চলে গেছে মহাকাশে তার কক্ষপথে। এই স্যাটেলাইটটি কিন্তু কখনো বাংলাদেশের মাটিতেও আসেনি। যাই হোক, অনেকেই হয়ত জানেন না যে এটি আসলে বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট। প্রথমটি ছিল আরো আগে, বাংলাদেশের ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ও জাপানের কিউশু ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির (কিউটেক) সমন্বিত প্রচেষ্টায় তৈরি করা ব্র্যাক অন্বেষা

 

কিউটেক তাদের BIRDS প্রকল্পের মাধ্যমে মহাকাশগামী নয় এমন দেশগুলোকে তাদের প্রথম স্যাটেলাইট তৈরির জন্য পৃষ্ঠপোষকতা করে। অন্বেষা এই প্রকল্পেরই ফসল। নিম্ন উচ্চতার কক্ষপথের (Low-Earth Orbit) জন্য তৈরি এই স্যাটেলাইট পৃথিবীর ছবি তুলতে এবং নিজের স্মৃতিতে থাকা গান পৃথিবীতে পাঠাতে পারতো। অন্বেষার নির্মাণ জাপানে হলেও এতে সরাসরিভাবে অংশ নিয়েছিল ব্র্যাকের চারজন ছাত্রছাত্রী, যাদের মধ্যে একজন এখন আমার সহকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরের তলায় তৈরি করা হয়েছিল গ্রাউন্ড স্টেশনকন্ট্রোল রুম। তাই প্রযুক্তিগত দিক থেকে এটা আসলে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের থেকেও আরও অনেক বেশি আমাদের নিজস্ব।

 

এই বিগত পদক্ষেপগুলোর ধারাবাহিকতায় পরবর্তী পদক্ষেপ হতে পারে নিজেরাই মহাকাশযান তৈরি করে ফেলা। শুনতে একটু আকাশকুসুম চিন্তা মনে হলেও ব্যাপারটা আসলে খুবই সম্ভব।

 

আমি গত তিন বছর ধরে জাপানের একটি মহাকাশযান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষক হিসেবে কাজ করছি। আমরা নতুন প্রযুক্তির রাডার ইমেজিং (SAR) স্যাটেলাইটের কন্সটেলেশন বানাচ্ছি যা দিয়ে পৃথিবীর যেকোন অংশের সাব-মিটার রেজ্যুলিউশনের রাডার ইমেজ তুলা যাবে ৫ থেকে ১০ মিনিটের ব্যবধানে মেঘ-বৃষ্টি-অন্ধকার যেকোনো পরিস্থিতিতে। ঘটনা ঘটার প্রায় একই সময়ে (Quasi real time) পুরো পৃথিবীর ম্যাপিং, যানবাহন ট্র্যাকিং, গুপ্তচরবৃত্তি এমন অসংখ্য ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে এ প্রযুক্তি, যার কয়েকটি আমরা ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছি। প্রতিষ্ঠানটি এখনো ছোট আকারে শুরুর দিকে আছে। আর আমি যোগ দিয়েছিলাম আরও আগে। তখন লোকবল ছিল কম, সবাইকেই সবকিছু করতে হত। তাই আমার সুযোগ হয়েছিল মহাকাশ শিল্পের অনেক কিছু খুব কাছ থেকে দেখার, বুঝার। মহাকাশ প্রযুক্তির সাথে সম্পর্কিত অনেক কিছুই, যেগুলো আগে খুব জটিল বা নাগালের বাইরের মনে হত, এখন বুঝি যে সেগুলো আসলে বেশ পার্থিব এবং প্রযুক্তিগতভাবে আমাদের আয়ত্বের মধ্যেই। এই লিখার মূল উদ্দেশ্যও এটাই মহাকাশ শিল্পকে তার বিভিন্ন উপাদানে ভাগ করে সেগুলোর কিঞ্চিৎ আলোচনা এবং যাচাই করা যে তা আমরা বাংলাদেশে আদৌ করতে পারি কিনা। 

 

নকশা:

প্রত্যেক ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রযুক্তিগত প্রকল্প শুরুই হয় নকশা প্রণয়ন থেকে। মহাকাশযানের ক্ষেত্রে এটাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়

১. কার্যপরিধির নকশাঃ আমরা যে মহাকাশযান বানাবো, সেটা কি কাজ করবে? এটা হতে পারে টিভির তরঙ্গ সম্প্রচারের জন্য যোগাযোগ স্যাটেলাইট কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ধস বা ভূমি জরিপের জন্য ভূমি পর্যবেক্ষণ স্যাটেলাইট। মূল কাজের জায়গাটা ঠিক করে সেটা অর্জনের জন্য কি কি করা প্রয়োজন সেটা নিয়ে গবেষণা করে বের করতে হয় বিদ্যমান কোন কোন মাধ্যম (Tools) বা প্রযুক্তি দিয়ে এই কাজটা সম্পন্ন করা সম্ভব। যেমন, যোগাযোগ স্যাটেলাইটের জন্য কোন ব্যান্ডের কয়টা চ্যানেল দরকার, ছবি তোলা বা ইমেজিং-এর জন্য কেমন ক্যামেরা লাগবে, অন্যান্য যন্ত্রের জন্য কি কি সেন্সর লাগবে সেগুলো ঠিক করা, ইত্যাদি। দেখা যায় যে বেশিরভাগ যন্ত্র বা যন্ত্রাংশের জন্যই প্রতিষ্ঠিত নির্মাতা আর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের পণ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করলেই আস্তে আস্তে বুঝা যায় এর সাথে মিলিয়ে কি ধরণের কম্পিউটার, পাওয়ার ইউনিট, কমিউনিকেশন বা অন্য জিনিসপত্র ব্যবহার করতে হবে। এরপর এই সব কিছু নিয়ে বসে মিলিয়ে নিয়ে বের করে ফেলতে হয় সবচেয়ে অনুকূল সিস্টেম আর্কিটেকচার। এটাকে ভিত্তি ধরেই শুরু হয় পরবর্তী উন্নয়নের ধাপগুলো। লক্ষ্য করে দেখুন পুরো কাজটাই একটা ঘরে বসে ইন্টারনেট আর কম্পিউটারেই করে ফেলা সম্ভব। 

 

২. ট্রাজেক্টরি বা নিক্ষেপণ পথের নকশাঃ স্যটেলাইটের কার্যপরিধির নকশার সাথে সাথে আরেকটা জিনিস নির্ধারণ করতে হয় স্যাটেলাইটের কক্ষপথ। মূল লক্ষ্যগুলোর অবস্থান, গ্রাউন্ড স্টেশনের অবস্থানসহ এমন আরও কিছু তথ্যের উপর নির্ভর করে সবচেয়ে অনুকূল কক্ষপথ নির্ণয় করে ফেলা যায়। এর জন্য কক্ষপথ সম্পর্কিত কিছু জ্ঞান থাকা দরকার, যা পরবর্তীতে কিছু মাধ্যম (Tools) ব্যবহার করে খুব সহজেই যাচাই করে নেয়া যায়। পুরো প্রক্রিয়াটার জন্য আসলে খুব বেশি যন্ত্রপাতি বা মানবসম্পদের প্রয়োজন নেই।

 

প্রাথমিক নকশার পর শুরু হবে আরেকটু বিস্তারিত পর্যায়ের গবেষণা ও উন্নয়ন। উন্নয়নের ধাপগুলো নিয়ে এখন স্বল্প পরিসরে আলোচনা করা যাক

 

ইলেক্ট্রনিক্সঃ

একটা মহাকাশযান মূলত বেশ কিছু ছোট ছোট ‘সাবসিস্টেম’ বা ‘মডিউলের’ সমষ্টি, যেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে এক বা একাধিক অন-বোর্ড কম্পিউটার। এই কম্পিউটার পৃথিবী থেকে কোন নির্দেশ পেলে সেই অনুযায়ী সাবসিস্টেমগুলোকে কাজে লাগিয়ে দেয় কোন একটা মিশন বা কাজ সম্পন্ন করার জন্য। তারপর সেই মিশন সম্পর্কিত তথ্য সে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয়। মেইন কম্পিউটার থেকে শুরু করে প্রতিটি ‘সাবসিস্টেম’, ইন্টার-সাবসিস্টেম কমিউনিকেশন, কন্ট্রোল সবই কিন্তু মূলত ইলেক্ট্রনিক্স, তাই এটাকে মহাকাশযানের প্রাণকেন্দ্র বলা যায়। একটা মহাকাশযানে যেসব বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ থাকে, তার বেশিরভাগই আবার মহাকাশযান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিজেরা বানায় না। সেগুলোর জন্য অন্য কোন নির্ভরযোগ্য নির্মাতার উপর নির্ভর করা হয়। এমনকি মূল কম্পিউটারের মত বিশেষায়িত যন্ত্রও বেশিরভাগ সময় বাইরের প্রতিষ্ঠানকে দিয়েই বানিয়ে নেয়া হয়। কারণ ভাল মানের যন্ত্র বানানোর জন্য যেই বিশাল কর্মযজ্ঞের দরকার, তা বছরে মাত্র দশ-বারোটা সার্কিট বানানোর জন্য একদমই উপযোগী না। বরং যাদের ইতোমধ্যে এই জিনিসগুলো ব্যাপকভাবে উৎপাদন করার সক্ষমতা রয়েছে, তারা এই জিনিস কম খরচে এবং নির্ভরতার সাথে বানাতে পারবে। এখানে নির্ভরতার অংশটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারন মহাকাশযানে কোন কিছু একবার নষ্ট হয়ে গেলে তা মহাকাশে গিয়ে ঠিক করে আসা সম্ভব না। যাই হোক, মহাকাশযানের ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যাপারগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়

 

১. বিশেষায়িত উপাদানঃ এগুলো মহাকাশের ভীষণ প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য বিশেষভাবে বানানো হয়। মূলত এখানে উপাদানগুলো বিকিরণ প্রতিরোধী করে তৈরি করা হয়। কাজটা ভীষণ জটিল হওয়ায় এসব উপাদানের দামও হয় আকাশচুম্বি। এগুলোকে র‍্যাডহার্ড কম্পোনেন্ট বলে। যেমন- RAD750 Single Board Computer । খুব কম প্রতিষ্ঠানই র‍্যাডহার্ড কম্পোনেন্ট বানায় এবং এগুলোর সক্ষমতাও তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়। এতটাই কম যে প্রচলিত অনেক অ্যালগরিদম, এমনকি অপারেটিং সিস্টেমও এগুলোতে চালানো যায় না। তাই পারতপক্ষে খুব দূরের (দূরের কক্ষপথ বা অন্য গ্রহ বা গভীর মহাকাশ) এবং লম্বা সময়ের জটিল মিশন না হলে এসব উপাদান পরিহার করা হয়। পৃথিবী পর্যবেক্ষণ স্যটেলাইটগুলো সাধারণত তুলনামূলক একটু নিচের দিকের কক্ষপথে থাকে। এখানে বিকিরণের প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম (দক্ষিণ আমেরিকার দিকে আবার বেশি। দ্রষ্টব্যঃ Van Allen radiation belt)। তাই এখানে র‍্যাডহার্ড ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যবহার বেশ কম। 

র‍্যাডহার্ড কম্পোনেন্ট তৈরিতে অনেক বিশেষায়িত জিনিসপত্র ও গবেষণা দরকার, যা বাংলাদেশে খুব সহজে স্থাপন করে আবার বানিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়াটা এই মুহুর্তে বেশ কঠিন হবে।

ছবি ১: BAE Systems RAD750 3U cPCI Single Board Computer

 

২. COTS উপাদানঃ র‍্যাডহার্ডের সমস্যাগুলোর কারণে তুলনামূলক নিচের দিকের কক্ষপথের জন্য Commercial Off-The-Shelf (COTS) উপাদানের ব্যবহারই বেশি হয়। এছাড়াও যেখানে বিকিরণের প্রভাব সহ্য করা সম্ভব বা অনেকদিন টিকে থাকার প্রয়োজন নেই সেখানেও এসব সাধারণ উপাদানই ব্যবহার করা হয়। এর একটা মজার উদাহরণ হল পৃথিবীর বাইরে উড়া প্রথম হেলিকপ্টার, Ingenuity। এর মূল কম্পিউটার তৈরি করা হয়েছিল Qualcomm Snapdragon 801 দিয়ে। এটা সেই একই প্রসেসর যা আমাদের মোবাইল ফোনে ব্যবহৃত হয়। দিন দিন মহাকাশে COTS উপাদানের ব্যবহার বাড়ছে। এমনকি উৎক্ষেপণ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্সও তাদের রকেটে পারতপক্ষে এইসবই ব্যবহার করে থাকে। তবে COTS উপাদান ব্যবহার করলে সেগুলোকে আলাদাভাবে প্রতিরক্ষা বা শিল্ডিং দিতে হয় বিকিরণ থেকে রক্ষা করার জন্য। সেই সাথে প্রতিটি উপাদানের একাধিক সেট থাকতে হয় যেন কোন কারণে একটা নষ্ট হয়ে গেলে বা কোন কাজে ভুল হলে সাথে সাথে অন্যগুলো তা  সংশোধন করে নিতে পারে।

 

মহাকাশযান নির্মাতা হিসেবে আপনি COTS উপাদানগুলো খুব সহজেই বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন। বাংলাদেশে এখন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত ইলেক্ট্রনিক সার্কিট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আছে (যেমন- ওয়ালটন, অন্যরকম ইলেক্ট্রনিক্স, টুআরএ টেকনোলজি) । চাইলে তারাও আপনার প্রয়োজন অনুসারে সার্কিট বানিয়ে দিতে পারবে। আর শিল্ডিং তো শুধু ধাতব প্লেটের কাজ। ভুল সংশোধন করার জন্য অ্যালগরিদম বানানোও খুব কঠিন কিছু না প্রয়োজন শুধু মেধার, আর আমার বিশ্বাস এটা আমাদের খুব ভাল ভাবেই আছে। 

 

ছবি-২ঃ ইলেক্ট্রনিক্স হবিস্টদের কাছে বহুল প্রচলিত Raspberry Pi Zero  দিয়ে তৈরি স্যাটেলাইট, GASPCAS

 

৩. পরীক্ষা-নিরীক্ষাঃ এটিকে ইলেক্ট্রনিক্সের মধ্যে নিয়ে আসলাম কারন এটা মহাকাশ প্রকৌশলের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সত্যি বলতে এটা আসলে এই শিল্পের অন্যতম প্রধান একটা কাজ। যেহেতু মহাকাশের পরিবেশ পৃথিবী থেকে একেবারেই আলাদা, তাই পৃথিবীতে যা কাজ করে তা যে ওখানেও করবে সেটার কোন নিশ্চয়তা নেই। এর একটা ছোট, কিন্তু মজার উদাহরণ হল ইলেক্ট্রোলাইটিক ক্যাপাসিটর। মহাকাশে ভ্যাকুয়ামের নিম্ন চাপে অনেকসময় এদের ভেতরের পদার্থ বাষ্পীভূত হতে শুরু করে। তাই এগুলো মহাকাশে ব্যবহার করা যায় না। একটা বিশাল সার্কিট বোর্ডে যদি এরকম একটা ক্যাপাসিটর থাকে, সেটা পুরো বোর্ডকেই অকেজো করে ফেলতে পারে । এরপর আবার রয়েছে তাপমাত্রার প্রভাব। পৃথিবীতে আমরা হর-হামেশাই গরম জিনিস ঠান্ডা রাখার জন্য বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করি, আবার  কিছু তাপ প্রাকৃতিকভাবে পরিবহন-পরিচলনের মাধ্যমেও আশেপাশে ছড়িয়ে যায়। কিন্তু মহাকাশে বাতাস নেই পাখা তো কাজ করবেই না, তাপের স্বাভাবিক পরিবহন-পরিচলনও সেখানে ঘটবে না। বিকিরণ ছাড়া তাপ হারানোর আর কোন উপায় না থাকায় একবার কিছু গরম হলে তা ঠাণ্ডা হতে অনেক সময় লাগে মহাকাশে। যেই সার্কিট বা প্রসেসর পৃথিবীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পূর্ণোদ্যমে চলতে পারে, সেটা হয়ত মহাকাশে এক ঘণ্টার মধ্যেই অতিরিক্ত গরম হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। তাই একটা মহাকাশযানের সবকিছু, বিশেষত ইলেক্ট্রনিক্স অংশটা বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করে নিতে হয়। এখানে মূলত বিকিরণ, ভ্যাকুয়াম, তাপমাত্রা এবং কম্পন সহনশীলতা পরীক্ষা করা হয়। উৎক্ষেপণের সময় রকেটের কম্পন অনেক বেশি থাকে, তাই এর জন্য সহনশীলতা থাকা অত্যন্ত জরুরী। 

 

অনেকক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানগুলো বাইরের কোন পরীক্ষাগারে এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকে। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারগুলো এই কাজে ব্যবহারের জন্য বেশ জনপ্রিয়। আমার এখানে জাপানের কিউশু ইউনিভার্সিটি, কিউটেক, ওসাকা ইউনিভার্সিটি সহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে বা যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে এই সেবাগুলো দিয়ে থাকে। আমাদের বাংলাদেশেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাকুয়াম চেম্বার, টেম্পারেচার চেম্বার, ভাইব্রেশন টেস্টিং সুবিধা রয়েছে। বিকিরণ পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা আছে। তাই একদম নতুন একটা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে সেটার জন্য আলাদা পরীক্ষাগার নির্মাণ না করে দেশের শিক্ষা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠাণগুলোর সাথে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সমন্বয় করে যদি যৌথভাবে কাজের একটা প্রক্রিয়া তৈরি করা যায়, তাহলে এই শিল্পের দ্রুত বিকাশ সম্ভব এবং এতে করে লাভবান হবেন সম্পৃক্ত সবাই। 

 

যোগাযোগঃ

মহাকাশ শিল্পের সবচেয়ে জটিল অংশ হল যোগাযোগ স্থাপন। বাইরের দুনিয়ায় থাকা একটা যন্ত্রকে পৃথিবী থেকে নিয়ন্ত্রণের একমাত্র মাধ্যম হল সুষ্ঠু যোগাযোগ পদ্ধতি। দূরত্ব, আপেক্ষিক গতি, মহাশূন্যে থাকা অন্যান্য বস্তুর অবস্থান এই সবকিছুর প্রভাবের কারণে এই যোগাযোগ পদ্ধতিটি বেশ জটিল।

 

ছবি ৩: (বামে) উত্তর মেরুর কাছাকাছি অবস্থিত পৃথিবীর সবথেকে বড় গ্রাউন্ড স্টেশন, Svalbard Satellite Station। সাদা সাদা গম্বুজগুলোর (Radome) ভেতরে রয়েছে আলাদা আলাদা অ্যান্টেনা (ডানের ছবির মত) । অ্যান্টেনাগুলো স্যাটেলাইটের কক্ষপথের উপর নির্ভর করে নিজের মাথা ঘুরিয়ে সেগুলোর অবস্থান নির্ণয় করতে পারে। ‘জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট’ ছাড়া বাকি সব ধরণের মহাকাশযানের সাথে যোগাযোগ করার জন্য এই ক্ষমতাটির প্রয়োজন হয়।

মহাকাশযানের চলার জায়গার (লো-আর্থ ~ জিওস্টেশনারি অরবিট/ ডীপ স্পেস/ অন্য গ্রহ) উপর ভিত্তি করে নির্মাতারা লিংক বাজেটিং-এর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যান্ডে (তরঙ্গদৈর্ঘ্য) তাদের নিজ নিজ মহাকাশযানের সাথে পৃথিবীর যোগাযোগ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পাওয়ার রেটিং নির্ণয় করেন। এর উপর ভিত্তি করেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এই যন্ত্রগুলো (মোডুলেটর/ ডিমোডুলেটর/ এন্টেনা) বেশ সংবেদনশীল। তাই এগুলো দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রস্তুতকারকদের থেকেই সাধারণত নেয়া হয়। আবার, যখন বড় বড় প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী যন্ত্র খুঁজে পাওয়া যায় না, তখনও সেগুলো এমন বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে ক্রয়াদেশ দিয়েই বানিয়ে নেয়া হয়। এনইসি, এরিকসনের মত যোগাযোগ-যন্ত্রাংশ তৈরি করা প্রতিষ্ঠানগুলো এমন অজস্র মহাকাশ প্রকল্পে বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ও মহাকাশযান নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি কাজ করেছে।

 

মহাকাশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন বেশ প্রমিত একটা খাত। কয়েকটা পদ্ধতি আর ব্যান্ডই ঘুরেফিরে সবাই ব্যবহার করে। তাই শুধুমাত্র এই সেবা প্রদান করার জন্যই গড়ে উঠেছে আলাদা একটি শিল্প স্পেস কমিউনিকেশন/ গ্রাউন্ড স্টেশন সার্ভিস। এ ব্যপারে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে সফটওয়্যার অংশে।

 

সফটওয়্যারঃ

মহাকাশযানে সফটওয়্যারের কাজ মূলত দুই খাতে হয় গ্রাউন্ড সেগমেন্ট আর স্যাটেলাইট (অনবোর্ড) সেগমেন্ট।

১. গ্রাউন্ড সেগমেন্ট সফটওয়্যারঃ একটা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় স্যাটেলাইট-ভিত্তিক সেবারও প্রায় সকল মিশন পরিকল্পনা আর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয় গ্রাউন্ড সেগমেন্টে’, পৃথিবীতে বসেই। এখানে সফটওয়্যারগুলো চলে মূলত সাধারন কম্পিউটার আর সার্ভারে। তাই সাধারণ সফটওয়্যার তৈরির যে প্রক্রিয়া তাই এখানে কাজে লাগানো সম্ভব। গ্রাউন্ড সেগমেন্টের কাজগুলোকেও কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়

 

ক) সিমুলেশন, অর্বিট প্রেডিকশনঃ মহাকাশের যেকোনো মিশন পরিকল্পনা বা কাজের ক্রমনির্ধারণে মহাকাশযান ও তার সাপেক্ষে সূর্য এবং পৃথিবীর অবস্থান জানা থাকতে হয়। এমনকি কখন, কোথা থেকে মহাকাশযানের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে সেটাও গাণিতিকভাবে সমাধান করতে হয়। এই সফটওয়্যারগুলো সাধারণত সিম্যুলেশনের মাধ্যমে এই সমাধান প্রদান করে থাকে। মহাকাশযান আর মহাকাশে অবস্থিত বস্তুর গতিপথ কিন্তু বেশ অনুমেয় কারন মূলত মাধ্যাকর্ষণ বল ছাড়া সেখানে আর কিছু থাকে না। কিন্তু তবুও সমাধান কতটা নিখুঁত হবে আর এর সাথে কি কি সুবিধা যোগ করা হবে এর উপর নির্ভর করে সফটওয়্যার বেশ জটিল হতে পারে। পৃথিবীতে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা কিনা শুধু এই অরবিট সিমুলেটর আর সেটাকে ভিত্তি করে বানানো মিশন প্ল্যানিং সফটওয়্যার বিক্রি করে। এরকম দুটো প্রতিষ্ঠান হল এজিআই আর অরবিট লজিক।

 

এ কাজের প্রায় পুরোটাই তাত্ত্বিক। আর সব বাণিজ্যিক স্যাটেলাইটের গতিপথের তথ্য প্রতিনিয়তই বিনামূল্যে প্রকাশিত হচ্ছে। তাই দেশে বসে এ ধরনের সফটওয়্যার বানানো ও যাচাই করা করা বেশ ভাল ভাবেই সম্ভব। যেহেতু এখন পৃথিবীব্যাপী মহাকাশ শিল্প বিকাশ লাভ করছে, আমরা মোটামুটি কম বিনিয়োগেই এ ধরনের সফটওয়্যার বানিয়ে মহাকাশভিত্তিক সেবার বাজারে নেমে পড়তে পারি। 

 

খ) যোগাযোগের জন্য সফটওয়্যারঃ এগুলো মূলত ড্রাইভার ধরণের সফটওয়্যার। মহাকাশযানে বিভিন্ন যোগাযোগ যন্ত্রের সফটওয়্যারের প্রয়োজন হয়। সিগনাল মডুলেটর/ ডি-মডুলেটরের ড্রাইভার, এন্টেনা কন্ট্রোলার এই সফটওয়্যারগুলো বেশ যন্ত্র নির্ভর। কোন নির্দিষ্ট যন্ত্রের সাথে নিজেদের প্রোগ্রামকে (নির্দেশ পাঠানোর বা টেলিমেট্রি গ্রহণ করার সফটওয়্যার) সংযুক্ত করার জন্য এ ধরনের সফটওয়্যার প্রয়োজন অনুসারে বানিয়ে নিতে হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা পৃথিবীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিজেরাই কিছু গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরি করে রেখেছে। একেকটা গ্রাউন্ড স্টেশনে সাধারনত বিভিন্ন ব্যান্ডের একাধিক এন্টেনা থাকে। যোগাযোগ ও এন্টেনা নিয়ন্ত্রণের কাজগুলো এরা নিজেরা তৈরি করে গ্রাহককে কিছু সহজ এপিআই দিয়ে দেয়। যেগুলোর মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে (যখন প্রয়োজন বা যখন মহাকাশযান ওই এন্টেনার সীমার মধ্যে আসে) মহাকাশযান নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ওই গ্রাউন্ড স্টেশন ব্যবহার করে নিজেদের স্যাটেলাইটে নির্দেশ পাঠাতে ও তথ্য ডাউনলিংক করতে পারে। নরওয়ের কেএসএটি এই সেবায় পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান। কিছু কিছু দেশে তারা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে অংশীদারিত্ব করেও গ্রাউন্ড স্টেশন বসিয়েছে। খুব বেশি যন্ত্র জড়িত না থাকায় এই জায়গাটাও আমাদের জন্য বেশ সুবিধাজনক হতে পারে।

 

২. স্যাটেলাইট (অনবোর্ড) সফটওয়্যারঃ এটা পুরোপুরি মহাকাশযান নির্ভর। নকশা এবং ব্যবহৃত যন্ত্রের উপর নির্ভর করে এটা একেক জায়গায় একেক রকম হবে। এই অনবোর্ড সফটওয়্যারেরও দুটো ভাগ আছেঃ

 

ক) এম্বেডেড সিস্টেমসঃ একদম “লো-লেভেলে” বিভিন্ন সেন্সর, একচুয়েটরের সংযুক্তি, FPGA বা মাইক্রোকন্ট্রোলারের প্রোগ্রামিং, RTOS-ভিত্তিক সাবসিস্টেমের প্রোগ্রামিং, ইত্যাদি। মহাকাশযানের ভেতরের সফটওয়্যার হলেও এগুলোর তৈরির পদ্ধতি কিন্তু প্রায় একই। শুধু এখানে শতভাগ নির্ভরযোগ্য করে বানিয়ে নিতে হয়। যেহেতু মহাকাশে পাঠানোর পর আমরা এর মধ্যে আর সরাসরি ঢুকতে পারবো না, তাই সফটওয়্যার এমনভাবে বানাতে হয় যেন সবকিছুই দূর থেকে দেয়া নির্দেশের মাধ্যমে কাজ করার উপযোগী হয়, প্রয়োজনে পরিবর্তন করা যায়, এবং কোনভাবেই যেন সিস্টেম হ্যাং/ ফেইল না করে। এটা নিশ্চিত করতে পারলেই মহাকাশযানের জন্য এই  সফটওয়্যারগুলো প্রস্তুত করা যেতে পারে। বাংলাদেশে 2RA, পাইল্যাবস, বা ইনোভিসের মত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের এই ধরণের কাজ করার সক্ষমতা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু প্রকল্পের।

 

খ) স্যাটেলাইট সিস্টেমসঃ কম্পিউটারের প্রধান প্রক্রিয়া, বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ, নির্দেশ পাঠানো এইসব কাজে ব্যাবহৃত হয় TCP/IP socket, WebAPI, MQTT-র মত আমাদের নিত্য নৈমিত্তিক প্রযুক্তিগুলোই। মহাকাশযান নির্মাতারা সাধারণত এই জিনিসগুলো নিজেরাই বানিয়ে নেয়। সাধারণ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দক্ষতাই আসলে এগুলোর জন্য যথেষ্ট আমাদের দেশে যার অভাব নেই।

 

কাঠামোঃ

সব শেষে এখন যন্ত্রপাতিগুলোকে একটা বাক্সে ঢোকাতে হবে। মহাকাশযানের এই বাহ্যিক কাঠামো তৈরির দায়িত্ব থাকে স্ট্রাকচারাল আর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের উপর। ইদানিং কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল আর হাল্কা ধাতুর সমন্বয় করে এই কাঠামো বানানো হয়। তবে এই ব্যাপারটা অনেকাংশে নির্ভর করে মহাকাশযানের স্বরূপ, ভেতরের যন্ত্রপাতি, ও তার গন্তব্যের উপর। বাহ্যিক কাঠামোর নকশায় বেশ কিছু জিনিস গুরুত্ব পায়, যেমন

  • ওজনঃ মহাকাশযান উড়ানো অত্যন্ত ব্যয়বহুল। আর এই খরচ ওজনের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। তাই ওজন যতটা সম্ভব কম হতে হয়।
  • আকারঃ যেই রকেটে করে মহাকাশযান শূন্যে পাঠানো হয় তার নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে আকারের ব্যাপারে। এছাড়া এই আকার মহাকাশযানের গতিকেও প্রভাবিত করে। এইসব মাথায় রেখেই নকশা করতে হয়।
  • বিকিরণ, তাপগতিবিদ্যা ও মিথস্ক্রিয়াঃ বাইরের বিকিরণ থেকে মহাকাশযানের সব উপাদানকে সুরক্ষা প্রদানের দায়িত্ব এর বাহ্যিক কাঠামোর। সেই সাথে তাপীয় ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া (যেমনঃ ম্যাগনেটোমিটারের উপর ম্যাগনেটিক টর্ক একচুয়েটর ও রিঅ্যাকশন হুইলের প্রভাব) মাথায় রেখে এদের মধ্যে আপেক্ষিক দূরত্ব, সর্বোত্তম অবস্থান ঠিক করে দিতে হয়।
  • কম্পনঃ উৎক্ষেপণের সময় এই কাঠামোকে রকেটের অতি উচ্চ তরঙ্গের কম্পন সহ্য করার উপযোগী হতে হবে।

এসব জিনিস মাথায় রেখে বিভিন্ন প্রচলিত সফটওয়্যার (যেমনঃ সলিডওয়ার্কস) দিয়েই এই নকশা প্রণয়নের কাজ করা যায়। আমাদের দেশে এই ক্ষেত্রে প্রচুর কাজ হচ্ছে, পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলও আছে। তাই এই অংশের কাজও বাংলাদেশে করা সম্ভব বলে মনে করি।

 

উৎক্ষেপণঃ 

মহাকাশযান বানানো শেষ। এখন একে তার কক্ষপথে নিয়ে যেতে হবে। এই কাজটি করে রকেট। পৃথিবীতে একদম হাতে গোনা কিছু সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান রকেট সেবা প্রদান করে থাকে। ইদানীংকালে স্যাটেলাইটের আকার ছোট হয়ে আসায় রাইড শেয়ারিং সেবাও চলে এসেছে। একই রকেটে একাধিক পে-লোড থাকে। মাটি থেকে প্রায় পুরোটা পথ তাদেরকে একসাথে উড়িয়ে নিয়ে রকেট শেষ পর্যায়ে গিয়ে এদের প্রত্যেককে তাদের প্রয়োজনভেদে আলাদা আলাদা গতিপথে পাঠিয়ে দেয়। অত্যন্ত জটিল এই কাজে সাফল্যের জন্য প্রচুর বিনিয়োগ এবং গবেষণা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিকভাবেও এই প্রযুক্তি বেশ নিয়ন্ত্রিত। কারন একই প্রযুক্তি ক্ষেপণাস্ত্র বানাতেও ব্যবহৃত হয়। তাই এই মুহুর্তে বাংলাদেশের পক্ষে সফলভাবে রকেট বানিয়ে কিছু একটা করা বেশ কঠিনই হবে।

 

ছবি ৪: রকেটের ফেয়ারিং এর ভেতরে এভাবেই মহাকাশযানগুলোকে রাখা হয়। একে তখন রকেটের “পে-লোড” বলে। নির্দিষ্ট উচ্চতা ও অবস্থানে যাওয়ার পর ‘ফেয়ারিং’ খুলে যায়, আর ‘পে-লোড’ ছুঁড়ে মারা হয় তার প্রত্যাশিত গতিপথে।

 

শেষকথাঃ

আশা করি উপরের আলোচনা থেকে পাঠক মহাকাশ শিল্পের কারিগরি দিকের ব্যপারে কিছুটা ধারণা পেয়েছেন। এই আলোচনা থেকে দুটো জিনিস খুব স্পষ্ট

  • এটি অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সহাবস্থান এবং পরস্পরের পরিপূরক হয়ে টিকে থাকা একটি শিল্প । আমরা শুধু নাসার নাম শুনি। কিন্তু নাসা দাঁড়িয়ে আছে অজস্র উৎপাদনকারী এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের উপর। 
  • পুরো মহাকাশযান একবারে দেখলে যতই জটিল মনে হোক না কেন, নির্মাণের পুরো প্রক্রিয়াটা ভেঙ্গে দেখলে বুঝা যায় যে এর ভিতরের বেশিরভাগ জিনিসই আশ্চর্যজনকভাবে সাধারণ

আর এগুলোর ভিত্তিতে বাংলাদেশে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিম্নোক্ত উপসংহারে আসা যায়

  • বাংলাদেশের সক্ষমতা আছে মহাকাশ প্রকল্পের বিভিন্ন অংশের সাথে যুক্ত হওয়ার।
  • সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে সংযুক্ত করতে পারলে বেশ ভাল ফলাফল আসবে। 
  • বাংলাদেশে ইতিমধ্যে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এরোস্পেস নিয়ে পড়াশুনার সুযোগ আছে (MIST, BSMRAAU) । এসব প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচী ও পরীক্ষাগার সুবিধা উন্নয়ন এবং বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে অনুদানের ব্যবস্থা করলে ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকেই অনেক ভাল ভাল চিন্তা, ভাল ভাল প্রকল্প উঠে আসবে। এরাই পরবর্তীতে পেশাগতভাবে এই ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে পারবে।  
  • মহাকাশযানের মূল খরচটা হয় উৎক্ষেপণে। বর্তমানে খুব কম খরচেই ছোট ছোট স্যাটেলাইট পাঠানো যায়। আবার আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের সাথে চুক্তি করে সেখান থেকেও স্যাটেলাইট গতিপথে পাঠানো সম্ভব। সরকার যদি বাৎসরিক কেবল একটাও উৎক্ষেপণের ব্যবস্থা রাখে, যেটার জন্য সারা দেশে বছরজুড়ে ছাত্রছাত্রী, স্টার্টআপ বা পেশাদাররা একটা প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে উঠে আসবে ৫ বছরে আমাদের অবস্থানটা কোথায় চলে যাবে একবার ভাবুন।
  • উৎক্ষেপণের পর পরিচালনার জন্য এই মহাকাশযানগুলোর গ্রাউন্ড স্টেশন সেবার প্রয়োজন হবে। এর খরচ ছাত্রছাত্রী বা উঠতি স্টার্টআপের জন্য অনেকক্ষেত্রেই জোগাড় করা সম্ভব হবে না। তাই স্থানীয় ভাবে কিছু সুযোগের ব্যবস্থা থাকলে এরা অনেক সুবিধা পাবে। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে দুটো গ্রাউন্ড স্টেশন আছে। সম্ভব হলে এগুলোকে এদের মূল কাজের পাশাপাশি এসব ছোটখাট স্যাটেলাইটকে সমর্থন দেয়ার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়াও যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এরোস্পেস বিভাগ আছে, তাদের অবশ্যই অন্তত একটা করে গ্রাউন্ড স্টেশন থাকা উচিৎ বলে আমি মনে করি। এই মুহুর্তে হয়ত এটাকে অতিরিক্ত খরচ মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এর ভূমিকা হবে অপরিসীম। স্টার্টআপ বা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে মিলে কাজ করে বা স্বল্পমূল্যে এসব সুবিধা ব্যবহার করে খুব দ্রুতই বিভিন্ন রকম উদ্যোগ শুরু করতে পারবে। খরচ কম হওয়ায় তারা সেই সেবা তুলনামূলক কম বিনিময় মূল্যে বিক্রিও করতে পারবে, যা তাদের পরবর্তী পর্যায়েও সফল হতে সাহায্য করবে।
  • সহজে ও সফলভাবে এ ধরনের বড় আঙ্গিকের প্রকল্প চালানোর জন্য আন্তর্জাতিক লেনদেন ও মালামাল পরিবহন ব্যবস্থাকে সহজ করতে হবে।
  • যেহেতু এই ক্ষেত্রটা একেবারেই নতুন, কিছু বড় বিনিয়োগের প্রয়োজন। সরকার মহাকাশ খাতে অনেক বিনিয়োগ করেছে, সামনেও করবে। পরবর্তী প্রকল্পগুলোর কিছুটা অংশও যদি দেশীয়ভাবে করানো যায়, সেটা একটা ভাল শুরু হবে হবে আমাদের জন্য।
  • বিদেশ থেকে মহাকাশ-সম্পর্কিত প্রকল্পে কাজ পাওয়ার জন্য আমাদের কাজের উপর অন্যদের আস্থা তৈরি করতে হবে। আর তার জন্যও শুরুতে কিছু সরকারী প্রকল্পে স্থানীয়দের যুক্ত হওয়ার সুযোগ অনেক বড় অবদান রাখবে।


শাদমান সাকিব সিয়াম মহাকাশ গবেষক হিসেবে জাপানের ইন্সটিটিউট ফর কিউশু পাইওনিয়ার অফ স্পেসে কর্মরত আছেন

 

MD IMRAN HOSSAIN
MD IMRAN HOSSAINhttps://themetropolisnews.com/
Md. Imran Hossain, a certified SEO Fundamental, Google Analytics, and Google Ads Specialist from Bangladesh, has over five years of experience in WordPress website design, SEO, social media marketing, content creation, and YouTube SEO, with a YouTube channel with 20K subscribers.

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

3,800FansLike
300FollowersFollow
250SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles