আরিফ হক-
মনে করুন আপনার দেশ তীব্র অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আর আপনি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধির সাথে তাল মিলাতে না পেরে হিমশিম খাচ্ছেন। এ অবস্থায় তাহলে আপনি কি করবেন?
আপনি হয় বিকল্প আয়ের চেষ্টা করবেন অথবা, ঘরের অপ্রয়োজনীয় বা অব্যবহৃত জিনিস নিয়ে সেগুলোকে কোন কাজে লাগানোর চেষ্টা করবেন। এতে আপনার ব্যয়ও কমে আসবে, আবার ফেলে রাখা জিনিসের উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে ঘরও পরিপাটি হয়ে উঠবে।
এখন যদি বলা হয় আমাদের শরীরেও ঠিক এমন কিছুই ঘটে থাকে, আপনি কি বিশ্বাস করবেন?
জ্বি পাঠক, এটা একেবারে শতভাগ সত্যি!
মানবদেহে ঘটে চলা ঠিক এমনই এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার হচ্ছে অটোফ্যাজি। এর ব্যাখ্যা প্রদান করেই জাপানের জীববিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহসুমি ২০১৬ সালে মেডিসিনে নোবেল জিতে নিয়েছেন। গ্রিক থেকে উদ্ভূত এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে “নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলা”। অটোফ্যাজি মানব দেহে সংঘটিত এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শরীর অপ্রয়োজনীয় কিংবা কম কর্মক্ষমতাসম্পন্ন কোষগুলোকে ভেঙ্গে আবার নতুনভাবে নিজেই গড়ে নেয়। ফলে আমাদের কোষের ক্ষতিগ্রস্ত প্রোটিন থেকে আরও শক্তিশালী ও কার্যকর প্রোটিন সৃষ্টি হয়।
আমাদের কোষের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে মাইটোকন্ড্রিয়া। এটি মাঝেমধ্যেই নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর তখন এর মেরামত বা প্রতিস্থাপনের মত জরুরী কাজটাই করে অটোফ্যাজি। এটি কোষ থেকে বর্জ্য অপসারণের পাশাপাশি সেই বর্জ্যকে উপযুক্ত কাজে লাগানোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন প্রাকৃতিক পদ্ধতিও বটে।
অটোফ্যাজি মানব শরীরের এমনই এক অপরিহার্য প্রক্রিয়া যা কোষের অভ্যন্তরীণ গঠনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে ঠিকঠাক ভাবে কাজ করার জন্য কোষে শক্তি ও পুষ্টি দিয়ে থাকে। ভেঙ্গে যাওয়া বা ক্ষতিগ্রস্ত কোষ, প্রোটিন কিংবা অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় উপাদান সরিয়ে আমাদের শরীরের সুস্থিতি বজায় রাখার জন্য এটি একটি অত্যাবশ্যকীয় প্রক্রিয়া।
আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা, কোষ বিভাজন এবং ভ্রূণের বেড়ে ওঠা – সব কিছুতেই অটোফ্যাজির ভূমিকা রয়েছে। এটি ঠিকভাবে কাজ না করলে ক্যান্সার, ডায়বেটিস, আর হান্টিংটন ডিজিসের মত আরও অনেক রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে পারে। শক্তিশালী অটোফ্যাজি মানে হচ্ছে- দীর্ঘ নীরোগ জীবন আর দুর্বল অটোফ্যাজি মানে অকাল বার্ধক্য।
টোকিও ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যাপক ইয়োশিনোরি ওহসুমি নব্বইয়ের দশকে সর্বপ্রথম অটোফ্যাজি নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। সে সময়ে এ ব্যাপারটা সবার কাছেই বেশ অজানা ছিল। শুরুতে অধ্যাপক ওহসুমি ঈস্টের কোষ ব্যবহার করে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। তিনি দেখতে পান যে, ঈস্ট কোষে পুষ্টি উপাদান কমে গেলে এটি নিজ কোষের প্রোটিন ভেঙ্গেই শক্তি উৎপাদন শুরু করে দেয়। ওহসুমি এই ঘটনার জন্য দায়ী জিন সনাক্ত করে প্রমাণ করতে সক্ষম হন এবং সিদ্ধান্তে উপনিত হন যে, মানুষের ক্ষেত্রেও এটি ঠিক একইভাবে কাজ করে। ১৯৯২ সালে ওহসুমি তাঁর এই অসামান্য আবিষ্কার জার্নালে প্রকাশ করেন।
ওহসুমির এই আবিষ্কারের মাধ্যমে অটোফ্যাজির কার্যপ্রণালী সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিষ্কার হয়েছে। ওহসুমি অটোফ্যাজির জন্য দায়ী জিন এবং প্রোটিন (ATG) বের করতে গিয়ে দেখতে পান যে এই কাজগুলো কেবলমাত্র নিয়ন্ত্রিত পরিবেশেই ঘটে থাকে। তিনি ঈস্টকে মডেল হিসেবে ব্যবহার করে এই জিনগুলো সনাক্ত করে অটোফ্যাজির সাথে এদের সম্পর্ক বের করে ফেলেন। অটোফ্যাজির জন্য দায়ী প্রথম ATG জিন বের করার পরপরই তিনি জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরবর্তী জিনগুলোও খুঁজে বের করে ফেলেন।
ওহসুমি তাঁর গবেষণার মাধ্যমে আরও বের করেন অটোফ্যাজি কিভাবে কোষের বিকাশ এবং বিপাকের জন্য অপরিহার্য বিভিন্ন সংকেত পথকে (যেমন TOR বা টার্গেট অফ র্যাপামাইসিন) নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। শুধু তাই নয়, ATG জিনকে থামিয়ে রেখে TOR সিস্টেম কীভাবে অটোফ্যাজি প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে – ওহসুমি এটিও সম্পূর্ণভাবে বের করতে সক্ষম হন।
শরীরের মধ্যে অটোফ্যাজি চালু করার একটা পদ্ধতি হচ্ছে লম্বা সময় ধরে উপবাস করা বা না খেয়ে থাকা। শরীর যখন স্বাভাবিক পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়, তখন অ্যানাবলিক অবস্থা (যা কোষের উপাদান গঠন করে) থেকে ক্যাটাবলিক অবস্থায় (যা কোষের উপাদান ভেঙ্গে ফেলে) চলে যায়। এই ক্যাটাবলিক অবস্থায় অটোফ্যাজির সূচনা হয়, যার ফলে শরীর ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত কোষ আর প্রোটিন ভেঙে এগুলোকে পুনর্ব্যবহার শুরু করে।
ভালভাবে অটোফ্যাজি চালু করার জন্য ব্যক্তিবিশেষের বিপাকশক্তির উপর নির্ভর করে ২ থেকে ৪ দিনের উপবাস প্রয়োজন হতে পারে। রক্তে গ্লুকোজ আর ইনসুলিনের মাত্রা যথেষ্ট কমে আসলেই অটোফ্যাজি শুরু হয়ে যায়। কিছু কিছু গবেষণায় উপবাসের ২৪ ঘন্টা পরেও রক্তের রোগ প্রতিরোধী কোষ নিউট্রোফিলে অটোফ্যাজির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তবে অটোফ্যাজির জন্য ঠিক কত সময়ের উপবাস দরকার এমন কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা এখনো পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
অটোফ্যাজি সম্পর্কে যদিও অন্তত ৫০ বছর ধরেই মানুষের কমবেশী ধারণা ছিল, কেবলমাত্র ইয়োশিনোরি ওহসুমির গবেষণার মাধ্যমেই শারীরবিদ্যা এবং ঔষধের ক্ষেত্রে এর তাৎপর্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অটোফ্যাজির ভূমিকা কী- সেটা বের করা সম্ভব হয়েছে। যদিও শুরুতে এটিকে প্রাথমিক পর্যায়ের ক্যান্সার কিংবা টিউমারের প্রতিরোধক হিসেবে পাওয়া গেছে, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার এর কারণে ক্যান্সার কোষের টিকে থাকার উদাহরণও দেখা গেছে। এমনকি কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপির মধ্যেও একে টিকে থাকতে দেখা গেছে। এই ধরণের অটোফ্যাজি ছড়ানো বন্ধ করার জন্য কিছু করা গেলে হয়ত এসব রোগের চিকিৎসায় আরও ভাল ফলাফল আনা সম্ভব হবে।
শুধু ক্যান্সার নয়, ওহসুমির গবেষণার ফলে পারকিনসন্স আর আলঝাইমারের মত স্নায়বিক রোগ সম্পর্কেও আরও ভালভাবে জানা গেছে। মস্তিস্কে কিছু ক্ষতিকর প্রোটিন জমে যাওয়ায় এই রোগগুলো হয়। মনে করা হচ্ছে অটোফ্যাজির মাধ্যমে এই ক্ষতিকর প্রোটিনগুলো নির্মূল করা সম্ভব হতে পারে। গবেষণার মাধ্যমে হয়ত এমন কোন ঔষধ বা চিকিৎসাপদ্ধতি বের হয়ে আসবে যা এই রোগগুলো সারানোর পাশাপাশি অটোফ্যাজি ঠিক কীভাবে কাজ করে সেটাও আরো সুস্পষ্টভাবে বের করে আনতে পারবে।
ওহসুমির গবেষণার ফলে ভাইরাল রোগের ক্ষেত্রে অটোফ্যাজির ভূমিকা কী হতে পারে, সেটা দেখারও একটা ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। কোষের মধ্যে টিকে থাকার জন্য ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাসের মত জীবাণু অটোফ্যাজিকে অচল করে রাখতে পারে। অটোফ্যাজি সম্পর্কে আরও ভালভাবে জানা গেলে গবেষণার মাধ্যমে হয়ত এমন কিছু বের করা যাবে যা জীবাণুর এই অচল করার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
শুধু রোগজীবাণুই নয়, মানব শরীরের কোষ কীভাবে কাজ করে এর ব্যাখ্যাও পাওয়া যায় ওহসুমির গবেষণার মাধ্যমে। অসংখ্য জিন আর প্রোটিনের সমন্বয়ে অটোফ্যাজি ঠিক কীভাবে কাজ করে এটা জানার মাধমে কোষের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
ঔষধ কিংবা চিকিৎসা ছাড়াও বিশেষ প্রযুক্তি উন্নয়নে এই গবেষণালব্ধ জ্ঞানের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই মানুষের জৈবিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানার ক্ষেত্রে গবেষণার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ওহসুমির এই কাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে থাকবে।
আরিফ হক একজন শিক্ষাকর্মী ও বিজ্ঞান লেখক। তিনি বাংলাদেশ বিজ্ঞান পরিষদের সভাপতি, শিখো টেকনোলজিসের রসায়ন-এর বিভাগীয় প্রধান এবং মনন একাডেমির পরিচালক।