তাহিয়া তাবাসসুম –
অর্থ বা মুদ্রাব্যবস্থা মানব সভ্যতার প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারগুলির মধ্যে অন্যতম যা বাণিজ্যের বিকাশের জন্য অপরিহার্য। প্রাচীনকালে বিনিময়প্রথার (একটি জিনিসের পরিবর্তে অন্য জিনিস ক্রয় করা) প্রচলন ছিল। মুদ্রা আবিষ্কার হওয়ার আগে মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য পণ্য ও পরিসেবার বিনিময় করত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন কৃষক সব্জির জন্য গবাদি পশু বিনিময় করতে পারে, আবার আরেকজন পশুর জন্য কাঠের বিনিময় করতে পারে।
ধারণা করা হয় এই বিনিময় প্রথার ইতিহাস প্রায় ৮,০০০ বছর পুরনো। ৬০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়ার উপজাতিরা ফিনিশিয়ানদের কাছে ধারণাটি চালু করেছিল। সে সময় মুদ্রার পরিবর্তে খাদ্য, লবন, অস্ত্রসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য বিনিময় করা হতো।
এরপর কয়েক শতাব্দী ধরে এ ধরনের বিনিময়ের বিকাশ ঘটে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। প্রথম দিকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তু মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল কড়ি শামুক। খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ সালে প্রথম এই ধরনের মুদ্রা ব্যবহৃত হয়। আরেক ধরনের প্রাকৃতিক মুদ্রা ছিল তিমির দাঁত, যা ফিজিয়ানরা ব্যবহার করত।
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে পশুর চামড়া মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। জানা যায় প্রাচীন রোমে এই ধরনের মুদ্রার প্রচলন ছিল। এছাড়াও ফ্রান্স, রাশিয়া এই দেশগুলোতেও এই ধরনের মুদ্রা ব্যবহার করা হতো। এখন আর এই মুদ্রার প্রচলন না থাকলেও অনেকে মনে করেন এইধরনের মুদ্রা একটি স্থায়ী উত্তরাধিকার রেখে গেছে।
খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালে মেটাল বা ধাতব মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়। ব্যাবিলন সভ্যতা থেকে পাওয়া যায় এই ধাতব মুদ্রা। আবার কিছু নিদর্শন থেকে ধারণা পাওয়া যায় ধাতব মুদ্রা ১২৫০ খ্রিস্টপূর্বের পুরনো। ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ধাতব মুদ্রা বা পয়সা ব্যবহৃত হয়েছে। প্রাচীন গ্রিকরাও প্রায় ৬৫০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে এসব মুদ্রা ব্যবহার করত। এই মুদ্রাগুলো ব্রোঞ্জ এবং তামার মত মূল্যবান ধাতুর থেকে তৈরি করা হতো।
সময়ের সাথে সাথে এই ধাতুগুলোর জায়গা দখল করে নেয় সোনা এবং রূপা। অর্থের ইতিহাসে এসব মুদ্রা একটি বিশাল মাইলফলক, কারণ ধাতব মুদ্রাই প্রথম ওজনের পরিবর্তে গণনা করে আদান প্রদান করা যেত। প্রায় ৫০০ খ্রিস্টপূর্বে, প্রথম বৃত্তাকার মুদ্রা তৈরি করা হয়েছিল এবং সত্যতার জন্য দেবতা ও সম্রাটদের দ্বারা স্ট্যাম্প করা হয়েছিল।
পশ্চিম বিশ্বের প্রাচীনতম মুদ্রা পাওয়া যায় প্রায় ৬৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আইওনিয়ার (পশ্চিম তুরস্কের) ইফেসাস শহরে। এই মুদ্রায় ব্যবহৃত ধাতুর নাম ইলেক্ট্রাম। এটি স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত সোনা এবং রূপার একটি প্রাকৃতিক মিশ্রণ। মুদ্রাগুলি শিমের আকৃতির এবং একপাশে সিংহ চিহ্নিত সিলমোহর করা থাকত। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল এই ধাতুমুদ্রার একটি স্থিতিশীল মান নির্ধারণ করা, যা পূর্বে শুধুমাত্র ওজন দ্বারা নির্ধারণ করা হত।
এক শতাব্দী পরে প্রতিবেশী রাজ্য লিডিয়ার রাজা ক্রোয়েসাস প্রথম শাসক হিসেবে খাঁটি সোনা এবং খাঁটি রূপার মুদ্রা প্রচলন করেন। এগুলি আগের মুদ্রাগুলির মতোই ছিল, তবে এগুলোয় কেবল একপাশে স্ট্যাম্প ছিল এবং তাতে একটি সিংহ ও একটি ষাঁড়ের মাথা মুখোমুখি থাকত।
সোনা, রূপা কিংবা অন্য ধাতুর মুদ্রা বেশি পরিমাণে বহন করা অসুবিধাজনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় সর্বপ্রথম চীনে কাগজের মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়। এই উদ্ভাবনটি সম্রাট জেনজং-এর রাজত্বকালে (৯৯৭-১০২২ খ্রিস্টাব্দ) ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। এটি তুঁত গাছের ছাল থেকে তৈরি করা হয়েছিল। ১৮ থেকে ১৯ শতাব্দির মধ্যে কাগজের মুদ্রা এবং ব্যাংকনোট পৃথিবীর অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যায়। চীন প্রথম কাগজের মুদ্রা ব্যবহারকারী দেশ হলেও ১৪৫৫ সাল পর্যন্তই তারা এই মুদ্রা ব্যবহার করে। চীন কাগজের মুদ্রা ব্যবহার বন্ধ করার পর ১৫ শতাব্দিতে আরও একবার পয়সা পুরো পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সাম্রাজ্যে প্রথম ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যাংকগুলো ঋণের পরিবর্তে মানুষের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ করতো। ১৯ শতকের শুরুতে ব্যাংকগুলি সমাজের মধ্যে আস্থার জায়গা করে নেয় এবং এ সময় রিজার্ভ ব্যাংকিং ধারণারও জন্ম হয়। যেহেতু মানুষ ব্যাংক থেকে তাদের সমস্ত অর্থ একবারে তুলে নেয়না, তাই ব্যাংকগুলোও শিখে ফেলে যে তারা তাদের প্রকৃত অর্থের চেয়েও বেশি অর্থ ঋণ প্রদান করতে পারে, যা অর্থের ইতিহাসে একটি বিশাল পদক্ষেপ ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ব্যাংক, দ্য ব্যাংক অফ দ্য ইউনাইটেড স্টেটস, ১৭৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
১৮১৬ সালে ইংল্যান্ডে স্বর্ণকে মূল্যের মানদণ্ড হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ প্রতিটি ব্যাংক নোট একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনার মূল্য হিসেবে নির্ধারিত হয়। তাই শুধুমাত্র সীমিত সংখ্যক ব্যাংকনোটই মুদ্রণ করা যেতে পারে। এটি মুদ্রার নির্দিষ্ট মান এবং স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। ১৯০০ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড আইন নির্ধারণ করে। এটি মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা পরিচালিত করার পরেও ১৯৩০-এর দশকের অর্থনৈতিক মন্দা এবং সোনার অবমূল্যায়নের কারণে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড শেষ হয়ে যায়।
এক্সচেঞ্জ বা বিনিময় বিল আরেকটি লেনদেন মাধ্যম যা বিশ্ব অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। বিনিময় বিল মূলত একটি লিখিত আদেশ যা কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর চাহিদা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করবে। একটি বিনিময় বিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি অ্যাকাউন্ট নিষ্পত্তি করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আধুনিক যুগে অর্থ হিসাবে “ইলেক্ট্রনিক মানি” ব্যবহার হচ্ছে যা সহজে পরিবহন ও স্থানান্তরযোগ্য এবং তাৎক্ষণিকভাবে স্বীকৃত। এতে খরচের রেকর্ড রাখা যায় এবং পেমেন্ট প্রদানে সুবিধা হয়। এটি তুলনামূলকভাবে ছোট লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত হয়। এই প্রক্রিয়া তথ্য প্রক্রিয়াকরণ স্থানান্তর, রেকর্ড রাখা এবং তথ্য খরচ হ্রাস করে।
ইলেক্ট্রনিক লেনদেন ব্যবস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় হল ক্রেডিট কার্ড এবং ডেবিট কার্ড। একটি ডেবিট কার্ড ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের সাথে লোড করা হয়, এরপর প্রয়োজনমত সেই টাকা ব্যবহার করা যায়।ক্রেডিট কার্ডগুলি এই অর্থে একটু আলাদা। এক্ষেত্রে কার্ডে টাকা নিজেকে লোড করতে হয়না বরং এই কার্ড দ্বারা ঋণ গ্রহন করা যায়। ঋণদাতারা কার্ডে সেট করার জন্য একটি ক্রেডিট সীমা রাখে , যা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পর্যন্ত খরচ করার অনুমতি দেয়। নিয়মিত ঋণপরিশোধের মাধ্যমে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার চালু রাখা যায়। ক্রেডিট কার্ড প্রথম ১৯২০-এর দশকে চালু করা হয়েছিল এবং তখন থেকেই এর জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
আধুনিক যুগে মুদ্রা আদান-প্রদানের নতুন এক পদ্ধতি হচ্ছে ক্রিপ্টোকারেন্সি বা গুপ্তমুদ্রা যা বাইনারি উপাত্তের একটি সংকলন যা বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। এর অস্তিত্ব শুধু ইন্টারনেট জগতেই বিদ্যমান। এটি ব্যবহার করে কেবল অনলাইনেই লেনদেন সম্ভব। ২০১৭ সাল থেকেই এটি একটি উঠতি বাজারে পরিনত হয়েছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সি এক ধরনের পিয়ার টু পিয়ার ব্যবস্থা। এতে তৃতীয় পক্ষের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাই কে কার কাছে এই ডিজিটাল মুদ্রা বিনিময় করছে তা অন্য কেউ জানতে পারে না। আবার পরিচয় গোপন রেখেও এটা দিয়ে লেনদেন করা যায়। তবে এর গুপ্তায়িত খতিয়ান (এনক্রিপটেড লেজার) সব লেনদেনকে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া থেকে নিয়ন্ত্রণ করে। ক্রিপ্টোকারেন্সির মানের উপর কোন দেশের সরকারেই হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা নেই। তাই পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ডিজিটাল মুদ্রার উপর সে দেশের সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সারা পৃথিবীতে প্রায় হাজারেরও উপরে গুপ্তমুদ্রা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে – বিটকয়েন, ইথেরিয়াম, লাইটকয়েন, রিপল, মোনেরো, ড্যাশ, বাইটকয়েন, ডোজকয়েন ইত্যাদি। তবে এগুলোর মধ্যে বিটকয়েন সবচেয়ে পরিচিত।