back to top
24.8 C
New York
Sunday, July 7, 2024

TMN Shop

spot_imgspot_img

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সঃ আরেক মহামারীর আশঙ্কা

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কথাটার সাথে আমরা এখন সবাই কমবেশি পরিচিত। কিন্তু আসলে শব্দ দুটি দিয়ে কী বোঝায় বা আমাদের বাস্তব জীবনে এর গুরুত্ব কতটা, সে সম্পর্কে কি আমাদের পরিষ্কার ধারণা আছে? কিভাবে এটি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে করোনা মহামারীর চেয়েও ভয়াবহ দুর্যোগের দিকে ঠেলে দিতে পারে, এবং সেই দুর্যোগ প্রতিহত করতে হলে আমাদের এখন থেকেই করণীয় কী, তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। এবং দুঃখজনকভাবে যাদের জানা আছে তারাও যথেষ্ট সচেতন নয়। 

আমাদের দেহে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস্, ছত্রাক বা প্রোটোজোয়া জীবাণুর আক্রমণে যে রোগগুলো হয়, যেমন নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, যক্ষ্মা, মেনিঞ্জাইটিস, ইউরিন ইনফেকশন, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি-কাশি, ডায়রিয়া ইত্যাদি, এদের বলা হয় সংক্রামক রোগ, এবং এইসব রোগের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত ওষুধ যা নির্দিষ্ট জীবাণুকে ধ্বংস করে শরীরকে রোগমুক্ত করে, তাকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগ। বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ মানুষ আগে মারা যেত সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার এবং ব্যবহারে বিপ্লব ঘটার পর সংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার অনেক কমে গিয়েছে, অপরদিকে অসংক্রামক রোগ যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সারের ফলে মৃত্যুহার বেড়ে গিয়েছে। মানুষ তাই সংক্রামক রোগ নিয়ে দুশ্চিন্তিত না হয়ে এখন অসংক্রামক এবং বংশগত রোগগুলো নিয়ে বেশি চিন্তিত। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নামক সমস্যা আমাদের সংক্রামক রোগের ভয়াবহতাকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারে।

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বলতে বোঝায় যখন নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং সেই জীবাণুটিকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়। জীবাণুদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে যা তাদের দৈহিক গঠন বা কার্যকারিতার পরিবর্তন ঘটাতে পারে, ফলে অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণুর যে দৈহিক উপাদান বা কাজের প্রক্রিয়ার উপর প্রভাব ফেলতো, তা পরিবর্তন হয়ে যাওয়াতে আর সেই প্রভাব ফেলতে পারেনা। ফলে অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণু ধ্বংস করতে পারে না এবং মানুষও দীর্ঘদিন রোগে ভুগে। বর্তমানে এই সমস্যা দিনদিন বাড়ছে, যার ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সকে শীর্ষ দশটি স্বাস্থ্য সমস্যার একটি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রতি বছর ১২ লক্ষ ৭০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে, এবং এশীয় অঞ্চলে এই সংখ্যা প্রতি লক্ষে ৭৫ জনের অধিক। 

এই সমস্যার পেছনে দায়ী অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত এবং অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। আমরা যেকোন ছোট খাটো অসুখ হলেও অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলি ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই। অনেক সময় ডাক্তাররাও পরীক্ষা না করেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবস্থাপত্র দিয়ে থাকেন। এছাড়া আমরা গরু, মুরগি ও অন্যান্য প্রাণীজাত যেসব খাবার খাই সেগুলোর মাধ্যমেও অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের শরীরে প্রবেশ করে, কারণ এসব প্রাণীদের খামারে তাদের সুস্থ রাখার জন্য, গাদাগাদি করে রাখার ফলে যে রোগ সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তা কমানোর জন্য নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক  দেওয়া হয়। এসব অ্যান্টিবায়োটিক বেশি মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করাতে জীবাণুগুলো তাদের সাথে পরিচিত এবং অভ্যস্ত হয়ে যায়। জীবাণুসমূহ খুব দ্রুত বংশবিস্তার করে ফলে জেনেটিক মিউটেশনের মাধ্যমে পরবর্তী বংশধরেরা অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের সক্ষমতা অর্জন করে এবং অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স দেখা দেয়। হাসপাতাল এবং অন্যান্য জনবহুল জায়গায় এসব রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু এক জনের থেকে অন্যজনের দেহে প্রবেশ করে এবং এভাবে প্রতিটি মানুষেই একসময় বহুল ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকগুলো তাদের কার্যকারিতা হারায়। 

যেহেতু নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, তাই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার পরও নতুন কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক সহজলভ্য হওয়ার জন্য আমাদের আরও দশ থেকে বিশ বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। তবে আমরা যদি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে না আনি, নতুন আবিষ্কৃত অ্যান্টিবায়োটিকও দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর হবে না। তাই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কমানোর জন্য এবং যেগুলো এখনো কার্যকর আছে সেগুলো যেন অকার্যকর হয়ে না পড়ে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করার কোন বিকল্প নেই। 

প্রথমত, সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার কোন বিকল্প নেই। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধ করতে হলে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ করতে হবে এবং তার জন্য হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, যেখানে সেখানে কফ থুথু না ফেলা, ব্যক্তিগত ব্যবহার্য দ্রব্য অন্যের থেকে আলাদা রাখা, রোগীকে পৃথক রাখা ইত্যাদি সাধারণ বিষয়গুলোকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। 

নিয়ম অনুযায়ী কোন রোগী সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তার লালা বা রক্ত থেকে নমুনা সংগ্রহ করে সে কোন জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত তা নির্ণয় করতে হবে এবং কোন কোন অ্যান্টিবায়োটিক তার দেহে কার্যকর হবে তা পরীক্ষা করাতে হবে (একে বলে কালচার সেন্সিটিভিটি টেস্ট)। এরপর নির্দিষ্টভাবে ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। আর টেস্টের রিপোর্ট পাওয়ার আগ পর্যন্ত এম্পিরিক্যাল থেরাপি বা আনুমানিক চিকিৎসার জন্য যে নির্দিষ্ট গাইডলাইন আছে তা অনুসরণ করে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে। গুরুতর প্রয়োজন ছাড়া অধিক শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব বা সেবন করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা যাবে না এবং প্রেসক্রিপশন ছাড়া কোন ফার্মেসিতে অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ বিক্রি করতে দেয়া যাবে না। ফার্মে্র পশুপাখিদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং রোগ প্রতিরোধের বিকল্প উপায় অনুসন্ধান করতে হবে। 

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ডিজিডিএ বা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য একটি গাইডলাইন বা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে। এই কর্মপরিকল্পনাতে দেশের সর্বত্র কোন ধরণের অ্যান্টিবায়োটিক কী পরিমাণে ব্যবহৃত হচ্ছে তার সঠিক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে অ্যান্টিবায়োটিককে লেভেল ১-৫ পর্যন্ত পাঁচটি পর্যায়ে শ্রেণিবিভক্ত করা হয়েছে। এতে করে একটি এন্টিবায়োটিক কোন ধরণের জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর, কোন রোগে ব্যবহার করা যাবে, কোন ধরণের রাসায়নিক উপাদানে তৈরি ইত্যাদি সহজে জানা যাবে। এছাড়া কোন ওষুধ দৈনিক সর্বোচ্চ কত ডোজ বা মাত্রায় কোন রোগীকে দেওয়া যাবে তা নির্ধারণ করা এবং নিয়ন্ত্রণের কথাও বলা হয়েছে। দেশের সকল পর্যায় থেকে অ্যান্টিবায়োটিক উৎপাদন, বিতরণ, বিক্রি, ব্যবহার সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। 

কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এর ভয়াবহতা এড়ানোর জন্য এই কর্মপরিকল্পনা যথেষ্ট নয়। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এবং কোনগুলো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ তা সহজে বোঝার জন্য আরও জন-সংযোগ মূলক উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবে বিদ্যমান কর্মপরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স মোকাবেলায় আমরা সামান্য হলেও এগিয়ে যাব এবং ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা অর্জন করতে পারব। সর্বোপরি মানুষের সঙ্গে অদৃশ্য এসকল জীবাণুর লড়াইয়ে মানুষের বিজয় এনে দিতে সরকার, ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী, রোগী এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত এবং সচেতন প্রচেষ্টার কোন বিকল্প নেই। 

 

মানিজা মুনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের স্নাতক পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী 

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

3,800FansLike
300FollowersFollow
250SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles