আদিল সাদ –
সকল প্রজন্মে সার্বজনীন এক নক্ষত্রের নাম হেলাল হাফিজ। তিনি বাংলা সাহিত্যের অগ্রগণ্য আধুনিক কবি। বাংলা কবিতার রাজকুমার হিসেবে শুদ্ধতা ও সমৃদ্ধ প্রকাশভঙ্গি যার চেতনা, মনন, সৃষ্টিকর্ম এবং ব্যক্তিত্বের নৈসর্গিক অলংকার। হৃষ্টপুষ্ট কষ্টের ফেরিওয়ালা তিনি। তারুণ্যকে, যৌবনকে কখনও মিছিলে, স্লোগানে, কখনওবা প্রেমে, ভালোবাসার প্রগাঢ় নীল স্রোতে মোহাবিষ্ট করে রাখার জাদুকর তিনি। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশকে অদ্যাবধি আন্দোলিত করে যে কাব্যগ্রন্থ, সেই “যে জলে আগুন জ্বলে”-র স্রষ্টা তিনি। “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তাঁর শ্রেষ্ঠ সময়” বাংলাদেশের কবিতামোদী ও সাধারণ পাঠকের মুখে মুখে এখনও উচ্চারিত হয়ে থাকে।
তাঁর জীবনের সব প্রহর কেটে গেছে একাকীত্বের কষ্টে আর নির্বাসনে। কখনও নিজেকে আড়ালে ঢেকে রেখেছেন, লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদে নিজেকে দুঃখী, আবার কখনও স্থির রেখেছেন। নিঃসন্দেহে বলতে হবে তাঁর লেখার জনপ্রিয়তা সমসাময়িক কবিদের চেয়ে শীর্ষে। আমাদের দেশে সাধারণত মহামানবদের যথাযথ মূল্যায়ন হয় না জীবদ্দশায়। মৃত্যুর পর আমরা ফুল হাতে নিয়ে তাঁর মরদেহের সামনে দিয়ে আসতে পারব, রাষ্ট্রীয় শোক জানাতে পারব, মোমবাতি জ্বালিয়ে তাঁকে স্মরণ করতে পারব। কিন্তু আজকে যে মানুষটি সারা জীবন কবিতার পিছনে ছুটে নিজেকে উৎসর্গ করে দিলেন, সারা জীবন ভালবাসার কাছে ঋনী হয়ে চিরকুমার থেকে গেলেন, নিলেন না সংসারের স্বাদ, পরিবার পরিজনের ভালবাসা, কোটি মানুষের হৃদয়ে ভালবাসার ফুল ফুটিয়ে নিজেকে যৌবনের মিছিলে বিলিয়ে দিলেন, সে মানুষটি কি আমাদের সমাজের পরিত্যক্ত আবর্জনা হয়েই কাটিয়ে দিবেন জীবনের শেষ বসন্তগুলো?
হেলাল হাফিজ পৃথিবীতে বারবার আসবেন না। তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে অমরত্ব পেয়ে গেছেন। তিনি কোন ভক্ত বা মানুষের করুণা নিয়ে বাঁচতে চান না। প্রচন্ড আড্ডাপ্রিয় এই মানুষটি বর্তমানে ধুঁকে ধুঁকে শেষ ঠিকানার দিকে ধাবিত হচ্ছেন। গত ২০শে অক্টোবর হাসপাতাল থেকে তিনি তাঁর পুরাতন ঠিকানা প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থিত কর্ণফুলী বোর্ডিং হোস্টেল উঠতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বোর্ডিংটি ভাড়া হয়ে যাওয়ায় তিনি আর সেখানে উঠতে পারেননি। এতো গুণী লোক থাকতে এই মহান মানুষটির থাকার জায়গা কেউ দিতে পারেননি। বরং কিছু অসাধু লোক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে কবির অনুমতি ব্যতিত তাঁর নামে সাহায্য চেয়ে টাকা লুট করার প্রতিযোগিতায় নেমে গিয়েছিল। এমতাবস্থায় এগিয়ে আসেন তাঁর ভক্ত, কবি এবং উকিল ইসমত শিল্পী, নিজের বাসায় রেখে কবিকে সেবা যত্ন করছেন। আবার তাঁর সততা ও সাহসী পদক্ষেপে প্রতারক চক্রও পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।
ইসমত শিল্পীর কাছ থেকে জানা যায় যে, চারবার ব্লাড টেস্ট, ইনসুলিন দেওয়া, ঔষধ ও খাবার খাওয়ানো এখন কবির জন্য প্রতিদিনের রুটিন। তাঁর নিজেরও যেহেতু পেশাগত কাজ, সংসার ও লেখালেখি আছে, এ সব কিছু করে একা কবির দেখাশুনা করা তাঁর জন্য বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাই তিনি এ কাজে সহায়তার জন্য একজন লোক চেয়েছেন। কিন্তু কবি হেলাল হাফিজ একটু সুস্থ হয়ে তাঁর আগের জায়গা প্রেসক্লাব ও কর্ণফুলী বোর্ডিং হোস্টেলে ফিরে যেতে চান। ৭৫ বছয় বয়সে তিনি কি পারবেন তাঁর একক শক্তি দিয়ে আবার সেই নির্বাসিত জীবনকে সঙ্গী করে নিতে? অসুস্থতা আর বয়সের ভারে তিনি এখন এক প্রকার অচল হয়ে গিয়েছেন বলা চলে। যে মানুষটি কখনও কারও কাছে নত হতে শিখেন নি, শুধু শিশু ও নারীর কাছেই নত হয়ে হেরে যেতে চেয়েছেন আজীবন, সে তিনিই আজ বার্ধক্যের প্রতিকূল স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর জন্য অনেক কিছু করেছেন। তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন, সঞ্চয়পত্র কিনে দিয়েছেন। নিজে চলার অর্থের জন্য কারও কাছেই চাওয়ার দরকার হবে না তাঁর। বর্তমানে কবির চাওয়া, যে প্রেসক্লাবে সমগ্র জীবন কাটিয়ে দিলেন সেখানে যদি তাঁর থাকার একটু আশ্রয় হতো, তাঁর চিকিৎসার জন্য রাষ্ট্র যদি একটু এগিয়ে আসতো, তাহলে হয়তো আরো কিছুদিন এই ধরনী দেখার স্বাদ পেতেন, নিজের আত্মজীবনীসহ আরো অন্তত দুইটা বই লিখে যেতে পারতেন। সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য চর্চার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে তিনি কবিতাকেই ফুল হিসাবে নিতে চান বাকী সময়টুকু। বর্তমানে এখন যৌবন যাদের তারাই সিদ্ধান্ত নিক, কবির জীবন শেষ প্রহরটি বেদনাদায়ক হবে, না বাকীটা সময় ভালোবাসায় পূর্ণ থাকবে।
সাদাকালো কাব্যে তুমি, লিখে দিয়েছো গল্প
ছন্দে আজ তরুন মন, বৃষ্টিতে ভিজেছে অল্প!
অল্প লিখে গল্প হয়ে থেকো বেঁচে এই ধরনীতে।
পরিত্যাক্ত আবর্জনা শব্দটা বেশ শ্রুতিকটু লাগলো। উনি স্বেচ্ছায় এ জীবন বেছে নিয়েছেন। উনার ভক্ত অনুরাগীরও অভাব নেই। উনাকে কেউও পরিত্যাক্ত আবর্জনা হিসেবে গণ্য করছেনা আশা করি৷ কবির সুস্থ জীবন কামনা করি।