back to top
28.3 C
New York
Thursday, July 4, 2024

TMN Shop

spot_imgspot_img

কাজ কি শুধুই দায়িত্ব?


মিতু একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এক বছর ধরে কাজ করছে। অফিসে তার পারফরম্যান্স বেশ ভালো, সামনে প্রমোশন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সহকর্মীদের সাথেও তার সুসম্পর্ক, প্রায়ই অফিসের পরে দল বেঁধে চা খেতে যায়। বেতন, যাতায়াত, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা, এসব নিয়ে তার বিশেষ কোনো অভিযোগ নেই, কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটা ভালো না লাগা রয়েই গেছে। প্রতি রবিবার সকাল থেকেই তার দিনগোনা শুরু হয়, কখন লাঞ্চ, কখন ছুটি, কখন শুক্রবার আসবে। 

 

ছবিঃ স্কট গ্রাহাম

 

মিতুর অবস্থার সাথে কি নিজের মিল খুঁজে পাচ্ছেন? বুঝতে পারছেন যে, চাকরিটা করা দরকার, তাই করেও যাচ্ছেন, কিন্তু সারাক্ষণই মনে মনে এর একটা বিকল্পও খুঁজছেন? বছরের শুরুতেই ক্যালেন্ডারে দেখেন কয়টা সরকারি ছুটি পাচ্ছেন, ছোটবেলায় যেমন মনে মনে চাইতেন, আমার যেন জ্বর হয়, স্কুলে যেন যেতে না হয়, অনেকটা সেরকম ভাবেই অফিসে যেন যেতে না হয় সেই আশায় থাকছেন? অফিস থেকে বের হলেই যেন শান্তি, পালাতে পারলেই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন? অথচ চাকরি পাওয়ার আগে মনে হত, এই চাকরি বা এই ধরনের একটা চাকরি পেলেই জীবনে আর কিছু চাই না! 

 

চাকরি নিয়ে যদি আপনার মনেও এমন অসন্তুষ্টি কাজ করে তবে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ‘স্টেট অফ দ্যা গ্লোবাল ওয়ার্কপ্লেসঃ২০২২’ অনুযায়ী শতকরা ৬০ ভাগ কর্মজীবী তাদের কাজের সাথে একাত্মতা অনুভব করেন না, মাত্র শতকরা ৩৩ ভাগ একাত্মতা অনুভব করেন, যা কিনা ২০২০ সালের চেয়েও কম। এ বছরের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপার্টমেন্ট অফ লেবার’ এর প্রকাশিত এক উপাত্তে দেখা যায় যে, প্রতি মাসেই লাখ লাখ কর্মজীবী তাদের কর্মক্ষেত্র থেকে চলে যাচ্ছেন। সপ্তাহে ৩০ ঘন্টা কাজ করতে হোক কিংবা ৬০, ঘরে বসে কাজ করতে হোক কিংবা অফিসে গিয়ে, সব ক্ষেত্রেই কর্মজীবীদের মাঝে কাজ নিয়ে অসন্তুষ্টির মাত্রা প্রায় একই। 

 

কর্মক্ষেত্র নিয়ে এত হতাশার কারণ তবে কি? অন্যতম প্রধান কারণ হল, কাজের বেড়াজালে আটকে গেছি মনে হওয়া। কাজের মাধ্যমে নতুন কিছু শেখার – জানার সুযোগ যদি না থাকে, তবে একই ধরনের কাজ করতে করতে একঘেয়েমি ও বিরক্তি চলে আসে। আরেকটি বড় কারণ হল, ভালো কাজের স্বীকৃতি না পাওয়া। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ অনেক পরিশ্রম করেও পুরষ্কার তো দূরের কথা, প্রশংসাও পায় না। এতে তার পরবর্তীতে কাজে ভালো করার আগ্রহ হারিয়ে যায়। পরিশ্রম অনুযায়ী যথাযথ বেতন না পাওয়াও কাজে ইস্তফা দেওয়ার জন্য দায়ী। এছাড়াও সহকর্মী বা উর্ধ্বতন কর্মকতাদের সাথে মতের মিল না হওয়া, কাজে অনিরাপদ পরিবেশ, চাকরির অনিশ্চয়তা, অতিরিক্ত লম্বা সময় ধরে কাজ করার বাধ্যবাধকতা, এবং সর্বোপরি কাজ ভালো না লাগা কর্মক্ষেত্রে অসন্তুষ্টির অন্যতম কারণ। 

 

এখন কথা হল, কর্মক্ষেত্রে ভালো না লাগলে চাকরি ছেড়ে দেওয়াই কি একমাত্র সমাধান? নতুন চাকরি যে ভালো লাগবে, সেখানেও একই ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে না, তার নিশ্চয়তা কি? কিংবা সবসময় সুবিধাজনক নতুন চাকরি কি আদৌ পাওয়া যায়? 

 

এটা সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি এমন হয় যে, চাকরি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে, নিজেদের আচরণে – অভ্যাসে – দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু পরিবর্তন আনার মাধ্যমে কর্মক্ষেত্র খুব আনন্দময় না হলেও অন্তত সহনীয় করে তোলা সম্ভব, যা আমাদের নিজেদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার জন্যই জরুরি।

 

  • কাজের সবগুলো বিষয় আপনার ভালো নাই লাগতে পারে, তবে কোনো না কোনো বিষয় নিশ্চয় ভালো লাগে। সে ভালো লাগার বা আগ্রহের বিষয়গুলো খুঁজে বের করে সেগুলোতে বেশি গুরুত্ব বা মনোযোগ দেওয়ার মাধ্যমে সার্বিকভাবে কাজের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলা সম্ভব। যেমন, শিক্ষক হিসেবে হয়ত আপনার পরীক্ষার খাতা দেখতে ভালো লাগে না কিন্তু ছাত্রদের নতুন কিছু শেখাতে ভালো লাগে। সেক্ষেত্রে এই সপ্তাহে আপনার কাছ থেকে ছাত্ররা নতুন কি শিখতে পারে, কত সৃজনশীলতার সাথে, কত আকর্ষণীয়ভাবে সেগুলো শেখানো যায়, সেদিকে মনোযোগ দিলে দেখবেন খাতা দেখাকেও সে প্রক্রিয়ারই একটা অংশ মনে হবে। 

 

  • নিজে খুব আগ্রহ নিয়ে কিছু করার পর, ভালো কোনো উদ্যোগ নেওয়ার পরেও যদি কেউ তার মূল্যায়ন না করে, তবে পছন্দের কাজে অনুৎসাহিত হতেও সময় লাগে না। সেজন্যই, টিম লিডার বা সুপারভাইজার কখন প্রশংসা করবে সে আশায় বসে না থেকে ‘সেল্ফ রিওয়ার্ড’ (Self-reward) দেওয়া জরুরি। যেমন, দিন-রাত পরিশ্রম করে সময়মত রিপোর্ট জমা দেওয়ার পরে একটু হাত-পা ছড়িয়ে বসে পছন্দের কফি আর মাফিন খাওয়া যেতেই পারে।

 

  • শুধু কাজের ক্ষেত্রে না, যেকোন ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ ভালো ফলাফল লাভের জন্য ‘মাইন্ডফুলনেস’ (Mindfulness) খুব জরুরি৷ মাইন্ডফুলনেস মানে হল, যখন যে কাজটি করছেন, সম্পূর্ণ মনোযোগ সেদিকেই নিবদ্ধ করা। আমরা অনেক সময় ছুটির দিনে বেড়াতে গিয়ে ভাবতে থাকি, কাল সকালে অফিসে গিয়েই ওই ফাইল নিয়ে বসতে হবে, অমুককে ফোন দিতে হবে; আবার, অফিসে বসে ভাবতে থাকি, আজ বাসায় যাওয়ার সময় লবণ কিনতে হবে, ওই সিরিজের নতুন পর্ব ডাউনলোড করতে হবে। এভাবে না আমরা ছুটি উপভোগ করতে পারি, না কাজে মনোযোগ দিতে পারি। সারাক্ষণই মনে হয় কাজ করছি কিন্তু কাজ আর শেষ হয় না। তাই কাজের সময়ে যদি সম্পূর্ণভাবে কাজের দিকেই মনোযোগ দেই আর বাসায় গিয়ে যদি পরিবারের সাথে সময়টা পুরোপুরি উপভোগ করার চেষ্টা করি, তবে কর্মক্ষেত্র ও পারিবারিক জীবনের মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখা সহজ হবে। 

 

  • অনেক সময় এমন হয় যে, কাজের ব্যস্ততায় সপ্তাহ শেষ হয়ে যায় কিন্তু সপ্তাহ শেষে মনে হয় যে, কি করলাম এতদিন, যা করব ভেবেছিলাম তার কিছুই তো হল না। এটা কর্মক্ষেত্রে কিংবা পারিবারিক জীবনে, উভয় ক্ষেত্রেই হতে পারে। এমন পরিস্থিতি এড়ানোর একটি ভালো উপায় হল, সপ্তাহের শুরুতেই পরিকল্পনা করা বা চেকলিস্ট তৈরি করা। আগামী সপ্তাহে আপনি কোন কোন কাজগুলো করতে চান কিংবা কোন মুভি দেখতে বা রেস্টুরেন্টে যেতে চান, সেগুলোর একটা তালিকা বানিয়ে ফেলতে পারেন। প্রতিদিনের শুরুতেই তালিকায় একবার চোখ বুলিয়ে দেখবেন যে, সেদিন কোন কাজগুলো করা যায়। এভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো বাদ পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাবে, আর সপ্তাহ শেষে তালিকায় চোখ বুলিয়েই বুঝতে পারবেন যে, কিভাবে সময়টা কেটেছে। 

 

প্রতিদিনের প্রায় অর্ধেক সময়ই আমাদের কর্মক্ষেত্রে বা সে সংক্রান্ত কাজে ব্যয় হয়। তাই কাজের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবেশ থাকা শুধু কর্মজীবন নয়, ব্যক্তিগত জীবনে ভালো থাকার জন্যও জরুরি। প্রতি সপ্তাহে শুক্রবারের আশায় দিন না গুণে যদি প্রতি রবিবার অভিনব কিছু শেখার, নতুন কিছু অর্জন করার আগ্রহ নিয়ে শুরু করা যায়, তবে ভালো হয় না? 

 

নাসরিন সুলতানা শীলা একজন মনস্তত্ত্ববিদ, শিক্ষক, কন্টেন্ট নির্মাতা, এবং লেখক

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

3,800FansLike
300FollowersFollow
250SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles