‘ঘুড্ডি’—একটি শব্দ, অথচ কত স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দেয়! কখনও তা দিগন্তছেঁড়া আকাশে নাটাই-বাঁধা মুক্ত বিহঙ্গের প্রতীক, কখনও বা সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর ক্যামেরায় বন্দি তারুণ্যের উদ্দাম প্রতিচ্ছবি। আবার কোনো বিষণ্ণ বিকেলে, এই নামটি যেন স্নিগ্ধ সুবর্ণার মায়াবী মুখখানি চোখের সামনে এনে দেয়। গভীর অনুভবে, ‘ঘুড্ডি’ আমাদের জীবনেরই প্রতিরূপ—কত অপ্রত্যাশিত রঙ, কত আকস্মিক বাঁক! তবে, এই শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের হৃদয়ের পটে যে প্রথম চিত্রটি জীবন্ত হয়ে ওঠে, তা হল উদোম গায়ের রাইসুল ইসলাম আসাদ এবং পাতলা শাড়ির স্লিভলেস ব্লাউজে স্বপ্নময়ী সুবর্ণা মুস্তাফার যুগলবন্দী। দূর কক্সবাজারের বেলাভূমিতে সেই সুর আজও যেন প্রতিধ্বনিত হয়—’আবার এলো যে সন্ধ্যা, শুধু দুজনে…’
১৯৮০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটি শুধু একটি কাহিনি নয়, যেন সময়ের স্রোতে ভেসে আসা এক ব্যতিক্রমী উচ্চারণ। এর নির্মাণশৈলী, এর বক্তব্য—সবকিছুই যেন তৎকালীন সমাজের ধরাবাঁধা ছককে অতিক্রম করে গিয়েছিল। ‘ঘুড্ডি’ কেবল তারুণ্যের উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা স্বপ্নের চিত্রায়ণ নয়, বরং এটি সেই চিরন্তন মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি—যে আকাঙ্ক্ষা যুগে যুগে তরুণ হৃদয়ে ডানা মেলেছে, সব বন্ধন ছিন্ন করে উড়তে চেয়েছে দিগন্তের পানে। এই ছবির নায়ক-নায়িকা যেন সেই বিদ্রোহী তারুণ্যেরই জীবন্ত প্রতীক। সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর কুশলী পরিচালনায় ‘ঘুড্ডি’ আজও বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অমলিন নক্ষত্র হয়ে দীপ্তি ছড়াচ্ছে।
‘ঘুড্ডি’র কাহিনীর সূত্রপাত এক লন্ড্রিতে—নায়ক আসাদের বন্ধুর লন্ড্রি, যেখানে অলস দিনযাপন তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই ছবির একটি বিশেষত্ব হল, এখানে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কোনো আরোপিত নামে ডাকা হয়নি; তাঁরা যেন পর্দার জীবনেও নিজেদের আসল পরিচয়েই পরিচিত। অর্থাৎ, আসাদ এখানেও আসাদ, সুবর্ণা এখানেও সুবর্ণা। তবে, এই পরিচিত নামের আড়ালে তাদের দুটি মিষ্টি ছদ্মনামও লুকিয়ে আছে, যার রহস্য উন্মোচন হবে কিছু পরেই।
ভোরের আলো ফুটতেই আসাদের পদচিহ্ন পড়ে বন্ধুর লন্ড্রিতে। কারণ তার কোনো নির্দিষ্ট কর্মব্যস্ততা নেই। কিছুদিন পূর্বে একটি গতানুগতিক চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে এখন মুক্ত বিহঙ্গ। তাই সকালের নির্লিপ্ততা কাটাতে বন্ধুর লন্ড্রির কাজে সামান্য সাহায্য করে, আর দ্বিপ্রহরে মতিঝিলের বন্ধুদের আড্ডায় যোগ দেয়—হাসি-ঠাট্টা আর মধ্যাহ্নভোজে সময় কাটে তার।
আসাদের কথায় ঢাকার আঞ্চলিক টান সুস্পষ্ট। বন্ধুদের সাথে আলাপের সময় প্রায়ই শোনা যায়—”কয় কী হালায়”, “বুঝছোস মামা”র মতো ঘরোয়া উচ্চারণ। তবে সুবর্ণা এবং তাদের বন্ধুদের সান্নিধ্যে তার ভাষা সংযত ও মার্জিত হয়ে ওঠে। একদিন লন্ড্রি থেকে একটি শার্ট গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ে আসাদ—উদ্দেশ্যহীন পথে ভেসে বেড়ানো তার স্বভাব। পকেটে রিকশাভাড়াও নেই! শাহবাগের কাছাকাছি এসে এক পুরোনো বন্ধুর গাড়িতে আশ্রয় নেয় এবং তার কাছ থেকেই রিকশাওয়ালার দুই টাকার ভাড়া মিটিয়ে দেয়।
এরপর তাদের গন্তব্য ‘কন্টি’—তৎকালীন হোটেল কন্টিনেন্টাল, যা কালের বিবর্তনে আজকের ইন্টারকন্টিনেন্টাল বা পূর্বে শেরাটন/রূপসী বাংলা!
কন্টির গাড়ি পার্কিংয়ে বন্ধুটি গাড়ি রেখে ভেতরে প্রবেশ করে, আর আসাদ বাইরে গাড়ির আসনে অপেক্ষার প্রহর গোনে। ঠিক সেই মুহূর্তে আবির্ভাব ঘটে ছবির স্বপ্নিল নায়িকা সুবর্ণার। সেখানেই প্রথম দৃষ্টি বিনিময় হয় দুজনের। নিজের গাড়িটি বের করার জন্য আসাদের গাড়ির সামান্য স্থানান্তরের অনুরোধ জানায় সে। সেই সুযোগে সুবর্ণা আসাদের নতুন গাড়ির প্রশংসা করে। আসাদও সুযোগটি হাতছাড়া করে না—এমন ভাব দেখায় যেন তিনিই গাড়ির মালিক এবং চালককে ভেতরে কোনো কাজে পাঠিয়েছেন।
এই অপ্রত্যাশিত আলাপে কথার ফুলঝুরি ফোটে, কিন্তু অকস্মাৎ বাদ সাধে সুবর্ণার গাড়ির নীরব ইঞ্জিন—কিছুতেই স্টার্ট নিতে চায় না। এমন অপ্রত্যাশিত সুযোগ কি আর হেলায় হারানো যায়! আসাদ তৎক্ষণাৎ লিফট দেওয়ার প্রস্তাব দেয় এবং বিদ্যুতের গতিতে বন্ধুর কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে আসে। হতভম্ব বন্ধু শুধু বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, আর তার গাড়িতেই সুবর্ণাকে নিয়ে অচেনা পথে পা বাড়ায় আসাদ।
পথের বাঁকে আসাদের বন্ধুর সেই চেনা লন্ড্রিতে ক্ষণিকের জন্য থামে সুবর্ণা। সেখানেই আধুনিক টি-শার্ট আর স্কার্টের আবরণ ছেড়ে জড়িয়ে নেয় শাড়ির স্নিগ্ধতা। আসাদের বন্ধু, পরিচয় জানা সত্ত্বেও পরিস্থিতির নীরব সাক্ষী থাকে। তখনও পর্যন্ত দুজনের হৃদয়ের আঙিনায় নাম না জানা ফুলের কলি।
হঠাৎ সুবর্ণার এক বান্ধবী পাশের রেস্তোরাঁ থেকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ডাকে—এই ঘুড্ডি! সুবর্ণাও হাসিমুখে প্রতিধ্বনি তোলে—“আরে লাড্ডু, তুই!”
এভাবেই উন্মোচিত হয় ছবির নামকরণের অন্তরালের রহস্য। সেই প্রেক্ষাপটে ধরলে, সুবর্ণাই যেন এই ছবির প্রাণ—নামভূমিকায় তার দীপ্ত পদচারণা। আসাদ যখন এই রহস্যময় নামের অর্থ জানতে চায়, তখন সুবর্ণা এক স্নিগ্ধ হাসিতে উত্তর দেয়, উড়তে সে বড় ভালোবাসে, আর সেই কারণেই বন্ধুরা আদর করে তাকে “ঘুড্ডি” নামে ডাকে।
এবার আসাদের নাম জানার পালা। সুবর্ণার বাড়ির দরজায় পৌঁছে যখন আসাদের নাম জিজ্ঞাসা করে সুবর্ণা, তখন এক লজ্জিত আভা তার মুখে খেলা করে। মৃদু স্বরে বলে, তার নাম সেকেলে, দাদুর রাখা, শুনলে হয়তো হাসবেন। এক লাজুক ভঙ্গিতে নিজের ছদ্মনাম উচ্চারণ করে আসাদ—’মহব্বত আলী’।
প্রথম দর্শনেই হৃদয়ের তারে বেজে ওঠে প্রেমের সুর। নায়ক স্বপ্ন দেখে এক কল্পরাজ্যের, যেখানে রাজকন্যা তার পাশে থাকবে; আর নায়িকা স্বপ্ন দেখে সব বাঁধন ছিন্ন করে মুক্তির স্বাদ পাওয়ার। এই সরল পথ ধরেই এগিয়ে চলে ‘ঘুড্ডি’র কাহিনি। আসাদের সেই লন্ড্রিমুখী ভবঘুরে জীবন, আর সুবর্ণার সাথে আবারও সেই চেনা লন্ড্রিতে অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ। তবে পরিচয় গোপন রাখার ব্যাকুলতায় লুকিয়ে থাকে আসাদ। ওদিকে সুবর্ণার চোখেমুখে ছবি দেখার ব্যাকুলতা—দুপুর তিনটের শো, শ্যামলী সিনেমা হলে।
আপনমনে কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে লন্ড্রিতে কাপড় রেখে দ্রুত পায়ে ছুটে যায় সুবর্ণা। আসাদও যেন অদৃশ্য এক টানে নায়িকার পিছু পিছু শ্যামলীতে পৌঁছায়, যদিও পকেটে কানাকড়িও নেই।
সিনেমা হলের প্রবেশদ্বারে দুজনের অপ্রত্যাশিত ধাক্কা—যদিও সেটি আসাদেরই এক অগোছালো চেষ্টা, সুবর্ণার দৃষ্টি আকর্ষণের এক ব্যর্থ প্রয়াস। সিনেমার বিরতিতে আবারও দুজনের সাক্ষাৎ—দুটি পেপসি আর দুটি রোলের বিনিময়ে। আসাদ একটু সময় চেয়ে আড়াল হয়, পকেট হাতড়ে দেখে তার সঞ্চয়ের পরিমাণ। হিসাব করে—দুইটা রোল দুই টাকা আর পেপসি… “যাহ শালা! ফাইস্যা গেলাম নাকি!”
এরপর দুজনের হৃদয়ের আঙিনায় ধীরে ধীরে জমে ওঠে বন্ধুত্বের বরফ। সুবর্ণা স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রী। আসাদও সুযোগ বুঝে বলে ওঠে, এটি তারও প্রিয় বিষয়। এরপর সুবর্ণাকে দেখা যায় বুয়েটের সবুজ চত্বরে, তার প্রিয় ক্যাম্পাসে। আর এই দৃশ্যেই আবিষ্কৃত হন হ্যাপি—ছবির মতোই বিরল এক চরিত্র, যাঁর সাক্ষাৎ পাওয়া যেন ভাগ্যের ব্যাপার। তিনি হ্যাপি আখন্দ—সেই সময়ের কিংবদন্তি গিটারিস্ট, সুরস্রষ্টা। ছবির কালজয়ী গান ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ তাঁর কণ্ঠেই যেন অমরত্ব লাভ করেছে। হ্যাপি সুবর্ণাকে নিয়ে যান তারিকদের বাসায়। তারিক, সুবর্ণার চাচাতো ভাই—এই চরিত্রে প্রাণ সঞ্চার করেছেন তারিক আনাম খান।
আবারও আসাদ-সুবর্ণা—এই ছবির দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। সুবর্ণার গাড়িতে করে গাজীপুরের শালবনের নীরব পথে যাত্রা করে তারা। কিন্তু সুবর্ণার গাড়ির তো খারাপ হওয়ার এক পুরোনো অভ্যাস। পথে সেটাই ঘটে। আর সেই বিকল গাড়ি ঠেলার জন্য তাদের সাথে এসে যোগ দেয় একদল প্রাণোচ্ছল শিশু। গাড়ি ঠেলাটাই যেন তাদের কাছে এক আনন্দময় খেলা।
সেই আনন্দমুখর পরিবেশে আসাদের কণ্ঠে শোনা যায় সুরের মূর্ছনা, আর সুবর্ণার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকে এক স্নিগ্ধ হাসি। শালবনের সবুজ অরণ্যে দুজনের অবাধ ছুটে বেড়ানো—যেন প্রকৃতির মুক্ত ডানায় ভর করে উড়ে যাওয়া। বন্ধুদের দেওয়া নামটি শুধু কথার কথা নয়, সুবর্ণা সত্যিই যেন আসাদের জীবনে এক মুক্ত ঘুড্ডি হয়ে আসে। সেই ঘুড্ডি ওড়ানোর নেশাতেই ধার করা গাড়ি, শার্ট আর মুখের এত কথার ঝর্ণাধারা।
এক অভিজাত রেস্তোরাঁয় আবারও দুজনের অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ। সেখানেই আসাদের দার্শনিক সত্তা যেন নতুন করে উন্মোচিত হয়। আসাদ বলে, রেস্তোরাঁর দামি খাবার আর সিনেমার নায়িকারা (শাবানা, নূতনের নাম নেয় আসাদ) নাকি একই রকম—তাদের দেখতে ভালো লাগে, সবসময় পেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কখনোই ছোঁয়া যায় না। তারা যেন সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরের কোনো জগৎ থেকে আসা।
সুবর্ণাদের বাড়ির আড্ডায় পাওয়া যায় ছবির অন্যান্য চরিত্রদেরও। প্রথমবারের মতো দেখা মেলে সুবর্ণার বাবা হাসান ইমামের। সেখানেই রাজনীতি নিয়ে তারিকের সাথে তার তীব্র বিতর্ক শুরু হয়। তারিক তার চাচাকে সরাসরি প্রশ্ন করেন, যে মানুষটি পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্ট ছিলেন, তিনি কীভাবে এত সহজে নিজের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে বিপুল ধনসম্পদ গড়ে তুলেছেন? ক্ষুব্ধ হাসান ইমাম তাকে উত্তর দেন, “ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় রয়েছে যা তুমি জানো না।”
একদিন এক বন্ধুর গাড়ি ধার করে, তো অন্যদিন অন্য বন্ধুর—এইভাবেই সুবর্ণাকে নিয়ে শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়ায় আসাদ (সুবর্ণার কাছে যে মহব্বত আলী)। সুবর্ণারও এই প্রাণবন্ত যুবককে ক্রমশ ভালো লাগতে শুরু করে। ক্লাসের একটি অ্যাসাইনমেন্টের জন্য মহব্বত আলীকে সঙ্গী করে সাভারের স্মৃতিসৌধে যায় সুবর্ণা। সেখানে তারা দেখতে পায় কেবল একটি স্তম্ভ—তখনও আজকের সুবিশাল স্মৃতিসৌধের নির্মাণ কাজ পুরোপুরি শুরু হয়নি।
এরপরের গন্তব্য নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও। সেখানে ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় যে ছোট্ট ছেলেটি, ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে ছাদের কিনারা থেকে পড়ে হঠাৎ তার জীবনের উড়ন্ত ঘুড্ডি থেমে যায়। মানুষের জীবনটাও হয়তো এমনই—ঘুড়ি ওড়ানোর মতো। একবার সুতো ছিঁড়ে গেলে নিশ্চিত পতন, যা ঠেকানোর সাধ্য কারো নেই।
চাকরি ছেড়ে আসাদের স্বপ্ন ছিল সিনেমার নায়ক হওয়ার। মতিঝিলে তার এক ধনী ব্যবসায়ী বন্ধু আছে, যার আশ্রয়েই তার দিন কাটে। সেই বন্ধুর কাছ থেকেই সে টাকা ধার নেয়, গাড়ি ধার নেয় এবং সুবর্ণাকে নিয়ে স্বপ্নিল পথে ঘুরে বেড়ায়। আসাদের হিরো হওয়ার আকাঙ্ক্ষার কথা বন্ধুটি ভালো করেই জানে। তাই একদিন আসাদকে সে নিয়ে যায় সিনেমার শুটিং স্পটে। সেখানেই নূপুরের (নায়লা আযাদ নূপুর) সাথে পরিচয় হয় আসাদের। সুবর্ণার মতোই, আসাদের মুক্ত আকাশে নূপুরও যেন এক উড়ন্ত ঘুড্ডি—সেও নিজের খেয়ালে উড়তে থাকে, আর আসাদ তাকে বাধা না দিয়ে বরং সঙ্গ দেয়।
এরপর আমরা প্রবেশ করি নূপুরের বেদনাবিধুর জগতে। নূপুর একজন নৃত্যশিল্পী—সিনেমার রঙিন পর্দায় নাচে, রাতের ক্লাবের ঝলমলে আলোতেও তার পায়ের ছন্দ থামে না। আসাদের সাথে নিজের জীবনের গভীর কষ্টের কথা ভাগ করে নেয় সে। জানায়, ঢাকা শহর ছেড়ে সে কোথাও যেতে চায় না। কারণ ২৫শে মার্চের কালরাতে এই শহরেই সে তার ভালোবাসার মানুষটিকে চিরতরে হারিয়েছে। তার মনে হয়, এই শহরের কোনো এক কোণে হয়তো একদিন আবার সেই প্রিয় মুখের দেখা মিলবে…
কিন্তু সেই অপেক্ষা আর শেষ হয় না। একদিন সন্ধ্যায় শেষবারের মতো ঢাকার মঞ্চে নৃত্য পরিবেশন করে চিরতরে বিদায় নেয় নূপুর।
থেকে যায় আসাদ, থেকে যায় সুবর্ণা। পুরো চলচ্চিত্রটি যেন তাদের অবাধ ঘোরাঘুরির এক রঙিন ক্যানভাস—সোনারগাঁওয়ের পর তাদের গন্তব্য দিগন্তবিস্তৃত কক্সবাজার। কিন্তু আসাদের পকেটে তখন শূন্য। বন্ধুর কাছে টাকা ধার চাইলেও সে আর দিতে রাজি হয় না। আসাদকে বাস্তবতার কঠিন মাটিতে ফিরে আসার তিক্ত সত্য জানায় সে। সুবর্ণার পেছনে অর্থ ব্যয় করার মতো সামর্থ্য তার আর নেই। অথচ আসাদের নিজের ঘরের ভাড়াও বাকি পড়ে আছে, সেদিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
অবশেষে সুবর্ণাকে নিয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে আসাদ। সঙ্গী কেবল সুবর্ণা। দুজনের হৃদয়েই যেন ঘরের ফেরার কোনো তাড়া নেই। সমুদ্রের অনন্ত ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে তারাও যেন নিজেদের হারিয়ে ফেলতে চায় গভীর থেকে গভীরে।
এই সমুদ্রযাত্রার পথেই ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে উত্তীর্ণ হয় তাদের হৃদয়ের ভাষা। সুবর্ণার ঘর বাঁধার স্বপ্নও ধীরে ধীরে রূপ নেয় বাস্তবে। আসলে ঘর বাঁধা নয়, বাবার স্নেহময় আশ্রয় ছেড়ে নিজের একটি স্বতন্ত্র জগৎ তৈরি করতে চায় সে—যেখানে আসাদের মতো একজন মুক্ত মনের সঙ্গীই তার একান্ত প্রয়োজন। সুবর্ণা কেবল একটি ঘুড্ডি হয়ে উড়তে চায়, যার নাটাই থাকবে আসাদের হাতে।
তাই সুবর্ণা আসাদের বাড়ি যেতে চায়। আসাদও তাকে নিয়ে চলে—তবে কোনো সাজানো গোছানো বাড়িতে নয়, এক টুকরো পতিত জমিতে। সেই অনুর্বর জমিটিকে নিজের দাবি করে আসাদ বলে, এখানেই তারা তাদের ভালোবাসার নীড় রচনা করবে। সুবর্ণার কেবল একটি ছোট্ট আবদার—তাদের শোবার ঘরের জানালায় সে গোলাপের চারা লাগাতে চায়।
ঢাকায় ফিরে আসাদের জীবনে নেমে আসে অপ্রত্যাশিত ছন্দপতন। মাসের পর মাস ভাড়া বাকি পড়ায় বুড়ি বাড়িওয়ালি তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আর সুবর্ণা যখন আসাদের অফিসে যায়, তখন সে জানতে পারে মহব্বত আলী নামের যে ধনী ব্যক্তির মায়াবী প্রতিচ্ছবি তার সামনে তৈরি করা হয়েছিল, তা আসলে একজন সাধারণ অভিনেতার নিপুণ অভিনয় ছাড়া আর কিছুই নয়। বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। অফিস থেকেই আসাদের আসল ঠিকানা জেনে দ্রুত পায়ে ছুটে যায় সুবর্ণা। ততক্ষণে আসাদ ভাড়াবাড়ি ছেড়ে পথের ধূলায় আশ্রয় নিয়েছে। সুবর্ণাকে দেখে সে পালিয়ে যায়।
কিন্তু সত্যিই কি পালানো সম্ভব? রাজকন্যা, রাজত্ব আর হিরো হওয়ার মায়াবী স্বপ্নে বিভোর আসাদের আর কিছু না হোক, সুবর্ণার প্রতি তার ভালোবাসা তো খাঁটি ছিল। সুবর্ণার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো সাহস তার না থাকলেও, হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা ভালোবাসার কথা জানানোর ব্যাকুলতা তাকে ফিরিয়ে আনে। দ্বিধা আর সংকোচ নিয়ে আসাদ ফিরে আসে সুবর্ণার কাছে।
বুড়িগঙ্গার বিষণ্ণ তীরে এক পড়ন্ত বিকেলে সুবর্ণার পাশে তখন তারিক। নদীর বুকে এক ভাসমান রেস্তোরাঁয় আসাদ সুবর্ণার পথ আগলে দাঁড়ায়। বলে, তার বলা সব কথা মিথ্যে হলেও তার ভালোবাসা খাঁটি। ব্যাকুল কণ্ঠে আসাদ মিনতি করে, “আমার সমস্ত শরীরজুড়ে ভালোবাসা। একবার ছুঁয়ে দেখ…”
সুবর্ণা সেই ভালোবাসার স্পর্শ অনুভব করতে পারে না। হতাশ আসাদ অকস্মাৎ নদীর স্রোতে ঝাঁপ দেয়—তারপর আর তার কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না।
কিন্তু আসাদকে ছাড়া সুবর্ণা তো অপূর্ণ। নায়কের করুণ পরিণতিতে সিনেমাও যেন তার সমাপ্তি খুঁজে পায় না। তাই আসাদ ফিরে আসে—সশরীরে নয়, ফিরে আসে আসাদের লেখা একটি চিঠি। প্রেরকের ঠিকানায় তারিকের নাম। সুবর্ণার সাথে দেখা করার আকুল মিনতি জানায় আসাদ। অভিমানী সুবর্ণা দেখা করবে না বললেও, তার অন্তরের গভীরে আসাদের জন্য ব্যাকুলতা তো কম নয়।
পরের দৃশ্যে আসাদকে দেখা যায় বুড়িগঙ্গার বুকে এক সাধারণ নৌকার মাঝি হিসেবে। সেখানে ক্ষণিকের জন্য দেখা মেলে প্রখ্যাত অভিনেতা গোলাম মুস্তাফাকেও—মাঝির ভূমিকায়। জীবনের গভীর তত্ত্ব নিয়ে মাঝির সহজ সরল কথাগুলো আসাদের হৃদয়ে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। নৌকা নিয়ে সে ভেসে বেড়ায় নদীর শান্ত স্রোতে। ঠিক সেই মুহূর্তে অন্য একটি নৌকায় সেখানে এসে হাজির হয় সুবর্ণা। অভিমানে আসাদ মুখ ফিরিয়ে নিতে চায়, কিন্তু সুবর্ণা তো আর দ্বিতীয়বার আসাদকে হারাতে দেবে না। আসাদের নৌকায় যাওয়ার জন্য ঝাঁপ দেয় সে—পড়ে যায় নদীর উত্তাল ঢেউয়ে। সুবর্ণাকে বাঁচাতে আসাদও ঝাঁপ দেয় এবং তাকে টেনে তোলে নৌকার বুকে।
আসাদের হাতে বৈঠা, নৌকার গলুইয়ে সুবর্ণা। তারা ধীরে ধীরে পাড়ে ফিরে যাচ্ছে—যেন জীবনের কাছেই ফিরে যাচ্ছে, এক নতুন সম্ভাবনার দিকে।