back to top
8.5 C
New York
Thursday, November 21, 2024

TMN Shop

spot_imgspot_img

চাদর


-তানভীর হোসেন-


মানুষের মন যখন কিছু একটা নিয়ে ভাবতে শুরু করে, তখন সেখানে বিচিত্র রসায়ন ঘটতে থাকে, নীলাভ রশ্মির মত ভাবনারা আরও গভীরে ঢুকে যেতে চায়। সে আলোর ধারা মনের যে দেয়ালে লাগে, সেখানে স্মৃতিগুলো জল ছবির মত ভেসে উঠে। সাবিহার কেবল মায়ের কথাই মনে পড়ছে, বড় হবার পর ঘন্টার পর ঘন্টা মায়ের সাথে আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছে। একদিন মাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো, আচ্ছা মা, তোমার কি কোন প্রেমিক ছিল, গোপন প্রেমিক, যার কথা বাবা জানতো না ? মা অবলীলায় বললো, সব মেয়েরই একজন গোপন প্রেমিক থাকে, কখনো সে বুঝতে পারে, কখনো পারে না ! বলো কি মা, তার মানে তোমার সত্যিই একজন গোপন প্রেমিক ছিলো? আমাকে নিয়ে চলো, তোমরা দুজন বসে কফি খাবে, আমি দেখবো, ওয়াও ! বেশ ইন্টারেস্টিং হবে, অনেকটা সিনেমার মতো! সোফায় শুয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে একনাগাড়ে কথাগুলো বলেছিলো সাবিহা। লিভিংরুমের দেয়ালে টাঙানো রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়ে মা হাসে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে, ভালোবাসা কোনো অধিকারের মধ্যে কাউকে আটকিয়ে ফেলে না বরং তাকে নতুন স্বাধীনতা দান করে। কথাগুলো মা রবীন্দ্রনাথ থেকেই কোড করেছিল।

এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সাবিহার মাথাটা কেমন যেন একটু ঝিম ঝিম করছে, গতকাল মাথা ঘুরে পড়ে যাবার পর থেকে সে এই হাসপাতালে ভর্তি। বাবুইকে স্কুল থেকে নিতে এসে এই দুরবস্থা! এর দুই দিন আগ থেকেই সাবিহার জ্বর, ঠান্ডা। জ্বর ছাড়লেও শরীর বেশ দুর্বল লাগছিলো, আসতেই মন চাইছিলো না। কিন্তু বাবুইকে কথা দিয়েছিল, মা নিতে আসবে। না আসলে সারা দিন গাল ফুলিয়ে কাঁদবে। এপ্রিল মাসের গরম, ঢাকা শহরের জ্যাম, আর দুর্বল শরীর নিয়ে রিকশায় চড়ে কোনোমতে স্কুলের গেইট পর্যন্ত আসতে পেরেছিল, সেখানেই মাথা ঘুরে পড়ে যায়। অন্য বাচ্চাদের মায়েরা, সবাই ধরাধরি করে স্কুলের ভিতর নিয়ে বসায়। সাবিহার সব মনে পড়ে না, কেবল মাথাঘুরে পড়ে যাবার মুহূর্তটা মনে আছে, এক সাথে লক্ষ তারার ঝিকিমিকি, তার পর অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া। সাবিহার মনে হচ্ছিল সে বোধহয় মারা যাচ্ছে, মারা গেলে মানুষ নিকষ কালো অন্ধকারে তলিয়ে যায়? সেই তলিয়ে যাবার মুহূর্তেই মাকে দেখতে পেলো, মা যেন দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। ছোট বেলা থেকেই সাবিহা পড়ে গেলে মা তুলতে যেত না, দাঁড়িয়ে হাসতো, সেই হাসির মধ্যে একটা অভয় লুকিয়ে থাকতো। সাবিহা ভাবতো এটা একটা খেলা বুঝি, পড়ে যাবার খেলা, যেখানে নিজেকেই উঠে দাঁড়াতে হয়।

সাবিহা উঠে দাঁড়ালো, ওয়াস রুমে যেতে হবে। সেটা বেড এর ডান দিকটায়। হাসপাতালের এই কেবিনটা সাবিহার বেশ পরিচিত। ৩১৩ নম্বর কেবিন। মা মারা যাবার সময় এই কেবিনেই ছিলেন। প্রথমে কেবিনটা মোটেই পছন্দের ছিল না। হাসপাতালে কেন এরকম আনলাকি নম্বরের কেবিন থাকবে ? মাকে বলেছিল, মা তোমাকে আমি এই কেবিনে রাখবো না, এমনিতেই তোমার এত বড় অসুখ, তার উপর এই ৩১৩ নম্বর এর কেবিন! মায়ের কাছে এটারও একটা সমাধান ছিল, মা বললো, শোন তিন যোগ এক যোগ তিন, মোট হলো সাত। হয়ে গেল তোর লাকী নাম্বার। পজেটিভিটি দৃশ্যমাণ থাকে না, ওকে খুঁজে নিতে হয়। ওয়াস রুমে ঢুকতে যাবে, এমন সময় বেল, কে এলো ? নির্মলার মা, বাবুই ? দরজা খুলে একজন বয়স্কমতন আয়া ঢুকলো। ম্যাডাম রুম ক্লিন করবো, আর আপনার বেডশিট কি চেঞ্জ করে দিবো ? এই হাসপাতালের ডাক্তার সময়মত না আসলেও আয়া নার্স একদম ঘড়ি ধরে আসবে। সাবিহা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে। একটু সময় নিয়ে বের হয়ে দেখে সব সুন্দর করে গোছানো।
সুন্দর ধব ধবে সাদা বিছানায় বসে সাবিহার মনে হল, এটাতো সেই চাদর, মা যেদিন মারা যায় সে দিন এই চাদরটা মায়ের গায়ে ছিল। হাসপাতালের সব চাদরই একই রকম, কিন্তু ওর এরকম ফিল হচ্ছে কেন ? সাবিহা এক টানে মেট্রেস থেকে চাদরের কোনা টেনে বের করে। সেখানে ঝাপসা হয়ে যাওয়া বলপয়েন্ট এর কালিতে মা লেখা। এটাতো সাবিহার নিজের হাতের লেখা ! গেল নভেম্বরে মা তখন এই হাসপাতাল ভর্তি, বাবুইর স্কুলে এক্সাম চলছিল, পরীক্ষা শেষে বাবুইকে নিয়ে মাকে দেখতে আসা। চেয়ার টেনে মায়ের মাথার কাছে বসে, সাবিহা বলল, কালকে কেমো টা দিলেই তুমি সেরে উঠবে, টেনশন করো না। বলতে বলতে হাতে থাকা বলপয়েন্ট দিয়ে চাদরের কোনায় মা লিখলো। তোর এই স্বভাবটা বুঝি আজও গেলো না ? না যাবে না, আমি সারা বিশ্বে লিখে বেড়াবো মা, মা, মা। মা হাসে, তুই একটা পাগল। এই পাগলামিটা সাবিহার ছোটবেলা থেকে, বই, খাতায়, টেবিলে যেখানে হাতে কলম পায় সেখানেই মা লিখে বেড়ায়। একবার মায়ের জন্মদিনে বাবা একটা সুন্দর সাদা জামদানী শাড়ী গিফট করে ছিল, সেই শাড়ী ড্ৰাই ওয়াসে দিয়ে মা স্লিপ হারিয়ে ফেলে। লন্ড্রি দোকান স্লিপ ছাড়া কিছুতেই শাড়ী দিবে না। মায়েরতো খুব মন খারাপ, বাবাকেও বলতে পারছে না, আবার শাড়ির মায়াও ছাড়তে পারছে না। শেষ পর্যন্ত বাবা জেনেই গেলো, বাবা সাবিহাকে জিজ্ঞেস করলো তুই কি শাড়িটা চিনবি ? সাবিহা মাথা নাড়ে। দোকানে যেয়ে সাবিহা ঠিক শাড়িটাই দেখিয়ে দেয়, লন্ড্রির মালিক কে বলে, আমার মায়ের শাড়ির আঁচলে মা লেখা আছে, লাল কালিতে। বাসায় ফিরতে ফিরতে বাবা বললো, ওটা কি তুই লিখেছিস ? সাবিহা শুধু হু দিয়ে উত্তর সারে। শাড়ী ফিরে পেয়ে মা যে কী খুশি, মা কত বার জানতে চাইলো তোমরা কিভাবে খুঁজে পেলে। বাবা সেটাকে রহস্যই রেখে দিলো।

সাবিহার হাসি পায়, মা নেই, তবু তার কথা গুলো মনে পড়তেই থাকে, এতটা আপন আর কেউ হবে না। বাবুই হয়েছে অনেকটা সাবিহার মত। সারাক্ষণ মায়ের আঁচলের নিচে থাকতে চায়। নির্মলার মা বাবুইকে স্কুল থেকে আনতে গেছে। মনে হচ্ছে ওদের আসতে আরো সময় লাগবে। নির্মলার মা সাবিহাকে নিজের মেয়ের মতই দেখে। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল দাশিয়ারছড়ায় নির্মলার মায়ের বসত ছিল, নির্মলা ও তার ভাইয়েরা ভারতে চলে গেলেও মা কে নিতে পারে নি, স্বামীর ভিটে ছেড়ে যেয়ে নতুন কোন অমঙ্গল চায় নি। কিন্তু অমঙ্গল আসতে চাইলেতো আর তাকে আটকে রাখা যায় না। শেষ অবধি সাবিহার মায়ের আশ্রয় ছিল নির্মলার মা, আর নির্মলার মায়েরও তাই। নির্মলার মায়ের একটা অদ্ভুদ সুন্দর নাম আছে, কল্পনা সাহা। সাহা বাড়ীর মেয়ের ঠমক টের পাওয়া যায় নির্মলার মায়ের রান্নায়। মারা যাবার আগে মা বলতেন, শোন, আমি ওর হাতের রান্না খাওয়ার জন্যই বেঁচে ছিলাম। সাবিহার মনে হতো, মা হয়তো খাবারের চাইতে রান্নার গল্প শুনতেই বেশি ভালোবাসতো। খাবারের স্বাদ লুকিয়ে থাকে, সে খাবারের পিছনের গল্পের মধ্যে। নির্মলার মায়ের গল্পের কোথাও হয়তো মা নিজেও হারিয়ে যেত!

মা যে দিন মারা যায়, তার আগেরদিন বিকেল পর্যন্ত সাবিহা মায়ের কাছেই ছিল, যাবার সময় নির্মলার মাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে যায়। সকাল সাত টায় মা কে কেমো দিতে নিয়ে যাবে, আমি বাবুইকে স্কুলে দিয়েই চলে আসবো। কোনো অসুবিধা হলে ফোন দিও। নির্মলার মা ফোন দিয়েছে ভোর পাঁচটায়। ‘মাগো দিদি কেমন যে করছে, হামি ডাক্তার ডাইকে এনছি, তারা দিদিকে আর একটা ঘরে নিয়ে গেছে, তুমি জলদি এসো’ সাবিহা জলদি জলদি এসেছিল, মা আরও জলদি চলে গেলো। আইসিইউ ডাক্তার জানালো, আমরা পেশেন্টের হার্ট বিট পাচ্ছি না, ক্লিনিক্যালী ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন, তবে আরও ছয় ঘন্টা দেখবো, আপনার পরিবারের সদস্যদের আসতে বলুন। শেষের কথাটা থেকে সাবিহা বুঝলো সব শেষ হয়ে গেছে। সেই চাদরটা দিয়েই মায়ের মুখ ঢেকে রাখা।

সেদিন সাবিহা কাঁদতে পারেনি, আর আজকে তার চোখে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে। মা মা করে ঢুকরে উঠছে, এই সেই বিছানা, এই সে চাদর মায়ের পরশ মাখা। কতক্ষণ ধরে কেঁদেছিলো সাবিহার মনে নাই, বাবুইকে নিয়ে নির্মলার মা এসেছে। সাবিহার চেহারা দেখে নির্মলার মা ভড়কে যায়, মাগো তোমার কি হয়েছে, কাঁদছ কেনে ? বাবুই এসে মাকে জড়িয়ে ধরে। সাবিহার আবার কান্না পায়। দুজন ডাক্তার আসে, সাথে নার্স। বয়স্ক মতন ডাক্তার সাবিহার চোখ দেখে, হাতের পালস দেখে। এখন কেমন আছেন ? বেশী খারাপ লাগছে ? এতো দুর্বল হলে চলবে ? আরও স্ট্রং হতে হবে। আমরা আর কয়েকটা টেস্ট করেই ছেড়ে দিব, আপনার হাজব্যান্ড এর সাথে আমার কথা হয়েছে। সাবিহা কোন উত্তর দিতে পারে না, শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে, কিছুতেই চোখের জল থামছে না। ডাক্তার বাবুইর দিকে তাকায়, বাবুই বলে, আই এম এ স্ট্রং গার্ল ! ডাক্তার নিচু স্বরে কিছু সাজেশন্স দেয়, জুনিয়র ডাক্তার ইয়েস স্যার, ইয়েস, ইয়েস বলে যাচ্ছে। ডাক্তার চলে গেল নার্সরা সাবিহার হাতে কেনোল্যা পরিয়ে দেয়, স্যালাইন এর সাথে কয়টা ইঞ্জেকশন, সাবিহা ঘুমিয়ে পড়ে।

সাবিহার যখন ঘুম ভাঙে তখন মাঝ রাত, তুষারের নাক ডাকার শব্দেই বোধহয় ঘুমটা ভাঙলো। তুষার সাবিহার হাজব্যান্ড, সোফা কাম বেডে শুয়ে আছে। ও একটা প্রাইভেট ব্যাংকে জব করছে, সাবিহাও করতো, কিন্তু বাবুইর জন্য ছেড়ে দিয়েছে। তুষার কখন এলো, বাবুই-নির্মলার মা কখন গেলো, কিছুই মনে নাই। তুষারের চেহারাটা কেমন নিষ্পাপ, মায়া ভরা। অসুস্থ্য থাকলে সম্ভবত কারো উপর রাগ থাকে না, অবশ্য তুষার এর উপর রাগ করে লাভ নাই, যে জীবনের আবেগ অনুভূতি ব্যাংকের লাভ-ক্ষতির খতিয়ানের মধ্যে গুলিয়ে ফেলে তার উপর রাগ করে কি লাভ।

তবু , তুষারকে দেখে আজ বড্ড মায়া হচ্ছে, মনে হচ্ছে তবু কেউ তো তার পাশে আছে। মাঝে মধ্যে মনে হয় ভালোবাসাটাও একটা অভ্যস্থতা, জাবর কাটার মত। ‘লোকে ভুলে যায়, দাম্পত্যটা একটা আর্ট, প্রতিদিন ওকে নূতন করে সৃষ্টি করা চাই’ রবীন্দ্রনাথের এ কথাটা মা প্রায়ই বলতো। তুষার সাবিহাকেই প্রথম ভালোবেসেছিল সেরকম কিছু নয়। সাবিহার জীবনে প্রেম, ভালোবাসা, যৌনতা, বিয়ে, সন্তান সবকিছুই যেন রেল গাড়ির মতো হুঁইসেল দিয়ে একসাথেই চলে আসে। রেলগাড়ির ইঞ্জিন যেমন সবার আগে, বগিগুলো একটার পর একটা জুড়ে দেয়া হয়, মানুষের মনের আবেগের সাথে বাকিসব জুড়ে যায়, আবার কখনোবা কোনো কামরা বিকল হয়ে যায়, তাকে সরিয়ে নিতে হয়, অথবা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়। কিন্তু জীবন সমান্তরাল লাইনের উপর বহমান থাকে , অন্তিম মুহূর্তের আশায়।
মা বলতো, নারীর জীবনে যৌনতা একটা পবিত্র অনুভূতি; তাই সেটা কেবল যোগ্য লোকের সাথে শেয়ার করতে হয়, জনে জনে বাটতে নেই। মা সম্ভবত সাবিহার প্রেম হয় হয় ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল; মা যেন কেমন, মুখ দেখেই বুঝে ফেলে! না শোনার ভাণ করলেও কথাটা মনে গেঁথে রয়েছে। কিন্তু, প্রথমবার সাবিহার মনে হয়েছে, ধুর ছাই ! এ কম্ম মানুষ করে ! এমন পাশবিক আচরণের জন্য পৃথিবীতে এত অশান্তি, এর মধ্যে পবিত্র অনুভূতি মা কোথা থেকে পেলো ? যেবার প্রথম অর্গাজম বিষয়টি এক্সপেরিয়েন্স করে, অনেকটা শূন্যে উড়ান দেবার মত, ভয়ংকর ঝোড়ো হাওয়ায় উড়তে উড়তে নিজের একান্ত পুরুষকে আঁকড়ে ধরে থাকা, ঝড় থেমে গেলেও যাকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না। সাবিহা ভাবে মায়ের কথাই হয়তো সত্যি, ওর চোখের জল গড়িয়ে কখন যে ঠোঁটে এসে লেগেছে টের পায় না, চোখ মোছে ঘড়ির দিকে তাকায়। বাবুই কে নিয়ে নির্মলার মায়ের ফিরতে আরও একঘন্টা লাগবে।

এখন কয়টা বাজে, আমার ফোনটা কোথায়? সাবিহা একটু উঠে বসার চেষ্টা করল। একটু ক্ষুদা লেগেছে, তুষারকে ডাকবো ? বেচারা সারাদিন খেটে খুটে এলো, একটু বিশ্রাম দরকার। হটাৎ করেই তুষারের নাক ডাকার শব্দ থেমে গেছে। সাবিহাকে বসে থাকতে দেখেই তুষার উঠে বসলো, তুমি কখন উঠলে, আমাকে ডাকোনি কেন?
-না না আমি ঠিক আছি। হাত টা একটু ব্যথা করছে। আমাকে কবে ছাড়বে ?
-কালকেই ছেড়ে দিবে, ডাক্তার বলেছে তুমি ঠিক আছো, কিছুদিন বেড রেস্ট নিলেই সেরে উঠবে, তাছাড়া;
– কি কোন খারাপ কিছু,?
– না তোমাকে একজন ভালো সাইকোলজিস্ট দেখতে বললো, তুমি কি কিছু নিয়ে আপসেট?
– না না আপসেট হব কেন ? কিছু খাব, ক্ষুদা লেগেছে; এখন রাত কয়টা ?
তুষার ব্যস্ত হয়ে যায়। কেবিনের ফ্রীজে রাখা স্যুপ, কেন্টিনের ওভেন থেকে গরম করে নিয়ে আসে। অনেক দিন পর ওরা দুজন, বাবুই পাশে নেই। অনেক দিন পর যেন আপন স্বর্গ থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে মর্তে শান্তি খুঁজে নেয়া। এরকম কোন কোন রাত গল্পেই কেটে যায়, কিছু মুহূর্ত থমকে যায় ভাবনায় ! সে রাত ওদের গল্পেই কেটে যায় , অনেক দিন পরে তুষারকে একটু আগের মতো মনে হলো, গল্প করতে, ঘুরতে, খেতে সব কিছুতেই তুষারের একটু বাড়তি উৎসাহ থাকত। এখন কাজের চাপে একবারে চিড়ে চেপ্টা। বাবুই ওদের দুইজনের সময়ের অনেকটাই নিয়ে নেয়, যেটুকু সময় থাকে তাতে ক্লান্তি এসে ভীড় করে। একটু আগেই তুষার নিজ হাতে স্যুপ খাওয়ালো, যেমনটা মা খাইয়ে দিতো। শেষরাতে সাবিহা আবার ঘুমিয়ে যাবার আগেই তুষার জানালো দুপুরেই ফিরবে, হাফ ডে লিভ নিয়েছে। বলবে বলবে করে শেষ পর্যন্ত চাদরের কথাটা আর তুষারকে বলা হলো না। কিছু অনুভূতি থাকে এমন যা মানুষ নিজের অবয়বের সাথেও শেয়ার করতে মানুষ দ্বিধাবোধ করে।
আরও একদিন হাসপাতলে থাকতে হলো সাবিহাকে। ধীরে ধীরে সুস্থ বোধ করছে সে। আজ রিলিজ পাবে। মায়ের চাদরটা আর বদলাতে দেয় নি। সকাল থেকে সাবিহার শরীরটা বেশ ভালো, নিজেই নাশতা করে নিলো, রাত থেকেই স্যালাইন বন্ধ, ক্যানোলা খুলে দেয়া হয়েছে । ডাক্তার এলো ঠিক দশটায়।
-আজকে কেমন আছেন?
-জ্বী ভালো।
আমরা সব পরীক্ষা করে দেখেছি, ভয়ের মত কিছু নেই, তবে তিনদিন পর এসে একবার সিটি স্ক্যান করে আমার চেম্বারে ফ্লিম আর রিপোর্ট টা দেখবেন। আপনার মেয়ে কই ?
-আজ বাসায় আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
-বাহ্ ভালো। আপনার হ্যাজবেন্ড তো ভীষণ প্রফেশনাল, দুইদিনেই আমার ব্যাংকলোনের কাগজপত্র পাঠিয়ে দিলো।
সাবিহার মনে হল এই সুযোগে চাদরটা চেয়ে বসবে। কিন্তু জড়তা কাটাতে পারছে না, যদি না দেয়! তুষারকেও বলতে পারতো, কিন্তু কি দ্বিধা যেন ওকে গ্রাস করেছে। মায়ের একটা চাদরের জন্য ফেবার নিবে ? আরও কতজনতো এই চাদর ব্যবহার করেছে। কিন্তু তবু কেন তার মন কিছুতেই এই চাদরটা ছেড়ে যেতে চাইছে না। বারটার দিকে সেই আয়া এলো, ম্যাডাম আজকে চলে যাবেন ? সাবিহার মনে হলো মাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, বুকের ভিতরটা আবার কেমন যেন হু হু করে উঠলো। একটা দীর্ঘশ্বাস। আয়া মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, কিছু চায় হয়তো। সাবিহা পাঁচশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলো। বেচারী খুব খুশি হলো, ম্যাডাম কিছু লাগলে ডাক দিবেন। আয়া চলে যাবে এইসময় সাবিহা ডাক দেয়, আচ্ছা খালা, আমি কি এই চাদরটা নিয়ে যেতে পারবো ?
-না ম্যাডাম, এটাতো হাসপাতালের, একটা কিছু গেলে আমাদের বেতন থিকা কাটে।
– এই চাদরটার দাম কত, আমি যদি দাম দিয়ে দেই।
– না ম্যাডাম, আমার চাকরি থাকবে না। ফ্লোর ইনচার্জ বেটা বদের হাড্ডি। একটা কিছু হলেই, সবদোষ আমাদের।
– খালা, এই চাদরটা আমার মায়ের গায়ে ছিলো, আমার মা ও এই হাসপাতালে মারা গেছে।
-হ ম্যাডাম, আমি নার্স আপারে কইছিলাম, এই ম্যাডামরে কইযেন দেখছি মনে হয়।

আয়ার সাথে কথা বলার উৎসাহ পায় না সাবিহা, ইশারায় চলে যেতে বলে। নার্স মেয়েটি কে একটু সংবেদনশীল মনে হলো, কিন্তু সেও অপারগতা জানালো। সাবিহার মনে হলো, আর না, মৃত্যুকালীন শয্যা, মৃত্যু পথযাত্রীকে কতটাই ধারণ করে ? যে চলে গেছে তার চাদর গায়ে জড়িয়ে বেঁচে ফিরুক অনেকে।
সাবিহা বাসায় ফিরেছে সাত দিন, জীবন পুরোনো ছন্দে ফিরেছে। সিটি স্ক্যান রিপোর্ট ভালো এসেছে, ডাক্তার সাহেব ব্যাংক লোন পেয়েছেন। তুষার এর সাথে যাওয়ায় একটু বেশি খাতির পাওয়া গেলো। ডাক্তার সাহবে ওদেরকে কফি অফার করলেন। একজন ব্যস্ত চিকিৎসকের রুমে বসে কফি খেতে কেমন যেন অস্বস্থি বোধ হচ্ছিলো।
-তুষার সাহেব, আপনার ওয়াইফের রিপোর্ট গুলো সব ঠিক আছে, ওনাকে দেখে আমার ভালোই মনে হচ্ছে। তবে, আমি সাজেস্ট করবো আরও কিছুদিন বিশ্রাম করবেন, বাড়তি টেনশন একদম করবেন না। আর আমাদের হাসপাতলের নতুন সাইকোলজিস্ট মিঃ রাফির একটা আপোয়েনমেন্ট করে দিচ্ছি, ভাবি এসে একটা সেশন করে যাবেন।
মুহূর্তেই কফিটা সাবিহার কাছে জঘণ্য লাগলো, তাহলে সে কী কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে ? এই দুঃশ্চিন্তা থেকে আবার না সত্যি মানসিক সমস্যা শুরু হয়ে যায়। ও যদি সত্যি পাগল হয়ে যায়, তাহলে বাবুইর কি হবে ? ডাক্তারের কথাটা কানের ভিতর ইকো হচ্ছে, মা তুমি আমাকে কি সমস্যায় ফেললে ? বাসায় ফিরতে ফিরতে তুষারকে প্রশ্নটা করলো, আচ্ছা তুষার, তোমার কি মনে হয়, আমার কোন মানসিক সমস্যা আছে ? ডাক্তার কি একটু বেশী বলছেন না ?
-না, ডাক্তার সাহেব তো সাইকিয়াট্রিস্ট এর কথা বলেননি;
-তার মানে কি ? ওই দুটো তো একই।
-না, একটু আলাদা, আমাকে ডাক্তার সাহেব বলেছেন তোমার বাইপোলার ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া ও ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারের কোনো সমস্যা নেই, কোনো ড্রাগ এবিউজ করো কিনা জানতে চেয়েছে ?
-তুমি কি বললে?
-আমি বললাম না। কোন ড্রাগ এবিউজের প্রশ্নতো উঠেই না। আমার মনে হয়, তোমার মনে কোথাও কোনো ডিসকমফোর্ট আছে, সেটা তুমি বা আমি ধরতে পারছিনা। সাইকোলজিস্ট হয়তো তোমার মানসিক অবস্থা, চিন্তাধারা বদলাতে সাহায্য করতে পারবেন।
সাবিহার একটু স্বস্তি লাগে, ওর কমফোর্ট, ডিসকমফোর্ট সবটা জুড়েই তার মা।
আরও সাত দিন পর হাসপাতলের মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে শিডিউল পেলো। হাসপাতালের এই কেন্দ্রটি নতুন, তের তলায়। এখনকার সময়ে কেবল ওষুধ দিলেই চলে না, রোগীর জন্য মানসিক কাউন্সিলিংও জরুরী। সাবিহা ভেবেছিলো কাঁচা-পাকা চুলের কোনো বয়স্ক লোকের সাথে কথা বলবে, সেই তুলনায় মি রাফি বেশ তরুণ, কাছাকাছি বয়সের মনে হলো।
মি. রাফি সাবিহাকে বেশ সুন্দর ভাবে ওয়েলকাম করলেন। ভদ্রলোক খুব শান্ত, টেনে টেনে গুছিয়ে কথা বলেন, পরিমিত হাসেন। রাফির সামনে একটা নোট বুক, পেন। আর সাবিহার সামনে কিছু সাদা কাগজ, আর তিন রঙের তিনটি পেন্সিল। রুমটা বেশে ছিমছাম করে সাজানো। একটা বুক সেলফ, তাতে কিছু বই, দেয়ালে একটা জল রঙে আঁকা স্টিল লাইফ কালো ফ্রেমে বাঁধা। তেরো তলায় হওয়ায় বেশ নিরিবিলি।
-সাবিহা, বলুন আপনার কি সমস্যা ?
-না মানে আমার তো কোন সমস্যা নেই। দুই সপ্তাহ আগে হটাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যাই, তারপর কয়েকদিন হাসপাতালে ছিলাম। টেস্টের রিপোর্টগুলো ভালো এসেছে, কিন্তু তারপর ও ডাক্তার রফিক বললেন আপনার সাথে যেন একটা কাউন্সিলিং সেশন করি। সে জন্য আসা। আমি সত্যি জানিনা আমার মধ্যে কোন প্রব্লেম আছে কি না।
রাফি মৃদু হাসলো।
-হুম, আমারও মনে হয় আপনার কিছু হয়নি, আপনি ভালো আছেন। তবু আপনার যদি কাউকে নিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে করে বলতে পারেন, যেমন ধরুন আপনার মায়ের কথা।
সাবিহা বড় ধরণের ধাক্কা খেলো। ওর সামনে বসা একজন তরুণ সাইকোলজিস্ট কি ওকে পড়তে পারছে ? রাফি আবারো মৃদু হাসে!
-দেখুন মানুষের মন পড়া খুব সহজ নয়, আপনি নিজের অজান্তেই লাল পেন্সিল দিয়ে মা লিখেছেন, এর মানে আপনার মায়ের সাথে একটা স্ট্রং কেমেস্ট্রি কাজ করছে, হতে পারে সেটা পজেটিভ কিংবা নেগেটিভ।
সাবিহা হাত ঘুটিয়ে নেয়। বিস্ফোরিত, টুকরো টুকরো ভাবনাগুলোকে জড়ো করার চেষ্টা করছে। তাহলে কি মায়ের গল্পটা রাফিকে বলবে? কি বলবে ? কোথা থেকে শুরু করবে, মা তার সবটুকু, যার শুরু নাই, কিংবা শেষ। সাবিহার মন আবার ছুটতে শুরু করেছে, গরুর বাছুরের মত, ছুটতে ছুটতে পড়ে যায়, আবার উঠে দাঁড়ায়।

সাবিহার মায়ের মৃত্যুর আগের রাতে শেষবারের মত দেখা হওয়া, আবার সেই ৩১৩ নম্বর কেবিনে নিজের এডমিটেড হওয়া, মায়ের মৃত্যুকালীন চাদর খুঁজে পাওয়া, আর শেষ পর্যন্ত চাদর টা নিয়ে যেতে না পারার হতাশা।
-আপনার গল্পটা বেশ ইউনিক, রাফি মুখ খোলে, তার মুখে সেই হাসি ঝুলে আছে, সবাই তার মাকে ভালোবাসে, শুধু আমরা নই, অন্য প্রাণীদেরও তাই। কিন্তু একই কেবিনে এডমিটেড হওয়া, একই চাদর খুঁজে পাওয়া খানিকটা কাকতালীয়, তবে এটা ঘটতেই পারে, একেবারে অস্বাভাবিক নয়। এটা অনেকটা ক্যাসিনোতে ব্যবহৃত জুয়ার এলগরিদম এর মতো। যে জিতবে সে নিজেকে ভাগ্যবান ভাববে, অথচ একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর কেউ না কেউ জিতবেই। ধরুন, এই হাসপাতালে ৩০০ বেডের বিপরীতে প্রায় ১ হাজার চাদর আছে, এই চাদরগুলো সব বিছানায় ঘুরে বেড়ায়। আপনি যে দিন ভর্তি হলেন, সেই দিনই চাদরটি রোটেশনে সেখানে চলে এসেছে, যেহেতু আপনি লিখে রেখেছিলেন তাই সেটা চিনতে পেরেছেন।
সাবিহা বেশে মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনে, কিন্তু তার মনের খটকা যায় না।
-আপনার কথা আমি মানছি, কিন্তু আমার মা আমাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছেন, যা তিনি বলে যেতে পারেননি। আমি জানিনা সেই চাদরটা পেলে হয়তো আমি কোনোদিন সেটা বুঝতে পারবো। আসলে আমি চাদরটা ফিরে পেতে চাই, আপনি কি আমাকে একটু হেল্প করবেন।
-নিশ্চই করবো, কিন্তু সেই চাদর খুঁজে পাওয়া এখন খড়ের গাঁদায় সুঁই খোঁজার মতো হবে। যদি না পান তাহলে ?
– বিশ্বাস করুন আমি পাবো, আমার ভুল হয়েছে, সে দিন নিয়ে যেতে পারলেই ভালো হতো, আমি ভীষণ অনুশোচনায় ভুগছি।
-আপনি একটু বসুন আমি আসছি, বলে রাফি বেরিয়ে যায়।
প্রায় ২০ মিনিট পর রাফি ফিরে আসে, সাথে একজনকে নিয়ে। মাঝ বয়সী পরিপাটি ভদ্রলোক বেশ কৌতূহল ভরে সাবিহাকে দেখছেন। রাফি নিজেই বলতে শুরু করে,
-ইনি মি. রতন কুমার, এই হাসপাতালের অ্যাডমিন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের ইনভেন্টরী দেখেন। হাসপাতালের কোথায় কি আছে তিনি সব জানেন। আমি উনাকে আপনার সেই চাদরটার কথা বলেছি; রতন দা বলুন।
-না মানে ম্যাডাম, আপনি সেদিন নিয়ে গেলেই ভালো করতেন। সেই চাদরটা এই মুহূর্তে কোথায় আছে বলা মুশকিল। হাসপাতালের চাদর বিচিত্র সব কাজে লাগে, আমরা আলাদা করে ট্র্যাক করতে পারিনা। আজকে যেটা কেবিনে, দুইদিন পরে ইমার্জেন্সিতে, তার তিনদিন পরে সেটাই বেডে বা আইসিইউতে।কেউ কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে রতন বাবু কনটিনিউ করে ;
-এই মুহূর্তে আয়রণ সেক্শনে আছে আড়াইশ চাদর আর পাঁচশ ত্রিশটার মত পিলো কভার, আর আমাদের নিচের স্টোরেই আছে চোদ্ধ থেকে পনের’শ এসবের মধ্যে কীভাবে খুঁজবো বলেন? আপনি যদি আমাদের এক মাস সময় দেন তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পারি, তবে কথা দিতে পারছি না।
একনাগাড়ে রতন বাবুর কথা শুনে, সাবিহার দৃষ্টি স্থীর হয়ে থাকে জল রঙের জড় জীবনে। যেখানে সব শব্দ এসে থেমে যায়! এই থেমে যাওয়া শব্দেরা কোন কোলাহল করে না, বরং নীরবতা ভাঙার অপেক্ষা করে।
রাফি ও রতন বাবু নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করে, রাফি কিছু বলতে যাবে, এমন সময় সাবিহা বলে,
-আচ্ছা দাদা আমাকে কী আপনার রুমে নিয়ে যাবেন ? আমার মনে হয় চাদরটা সেখানে আছে।
-না মানে আমার ওখানেতো অনেক চাদর, এত কিছুর মধ্যে আপনি কিভাবে খুঁজে পাবেন, আমি বরং আয়রণ সেকশন এ বলে দিচ্ছি ওরা এরপর সব চাদর চেক করবে, আপনার মায়ের টা পেলে আমাকে জানাবে।
-কোন অসুবিধা নাই দাদা, আমি জাস্ট একটু দেখে আসবো। সাবিহার দুচোখে অনুনয়, উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ে। রতন বাবু আর রাফির মধ্যে চোখাচোখি হয়। রাফি সম্মতি সূচক মাথা নাড়ে।

-না মানে আমাদের ওয়াসিং সেকশন টা বেজমেনন্টে, আপনি সেখানে যাবেন ?
বেজমেন্টের এক পাশে পার্কিং, অন্যপাশে কয়েকটি রুম মিলে একটা ছোট ওয়াসিং প্ল্যান্ট, বয়লার, গ্যাস পাইপ,অটোমেটিক ওয়াসিং জার, দুটো আয়রণ টেবিল, শেষ প্রান্তে ডেলিভারী রুম। এখন থেকেই পুরো হাসপাতালে লন্ড্রি সাপ্লাই করা হয়। চারদিকে ব্লিচিং পাউডার আর ক্লিনিং এজেন্টের গন্ধ। হাসপাতালে যারা কাজ করে তাদের এ তীব্র গন্ধটা সয়ে যায়। কিন্তু সাবিহার গা গুলিয়ে আসে, নিজের ওড়না নাকে চেপে ধরে সাবিহা এগিয়ে যায়। সামনে রতন বাবু , একটু আড়াআড়ি ভাবে পিছনে রাফি। সাবিহা জানে রাফির দৃষ্টি সাবিহার দিকে, এমনিতেই সাবিহা দেখতে সুন্দর, ছেলেদের তাকানোর মানে সে বুঝে, এবং এটাও বুঝে রাফি সাবিহার প্রতিটি আচরণ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে, সেখানে কোন অসলগ্নতা আছে কি না তা দেখার জন্য, কিছু পেলেই রাফি নিজের মাথায় সেটা টুকে রাখবে।
রতন বাবু তালা খুলে স্টোর রুমে ঢুকলেন, সাবিহা ও রাফি তাকে অনুসরণ করে। রুমে আলো জ্বলছে, বোঝা যাচ্ছে একটু আগেই সেখান থেকে রতন বাবু উঠে গেছেন। রুমের ভেতরটা বেশ অনেক গুলো সেলফ, প্রতিটি সেলফের উপর কত তলার জন্য তা লেখা। সবগুলো সেলফে চাদর বোঝাই। মাঝখানে একটা টেবিল তারউপর কয়েকটা বড় টালিখাতা, একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার, একটাই বসার চেয়ার। সাবিহা পুরো রুম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। মাগো, এ তুমি কী অথৈই সাগরে ফেললে আমায়, আমি কি ভাবে খুঁজে পাবো তোমার চাদর ?
-স্যার, এতগুলো চাদরের মধ্যে একটা কি খুঁজে বের করা সম্ভব? আপনি বলেন, রতন বাবু রাফির উদ্দেশে বলে।
– সেটা হয়তো কষ্টসাধ্য কিন্তু একেবারে অসম্ভব নয়! রাফি উত্তর দেয়।

ওরা দুজনেই সাবিহার দিকে চেয়ে আছে। সাবিহা একটু অন্যমনস্ক সেলফ গুলোর দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে। রাফি নীরবতা ভাঙে, আপনি কি কোনো একটা সেলফ চেক করতে চান ?
-না তার দরকার নেই, আমার মনে হয় চাদরটা এখানে নাই। চাদরটা থাকলে আমি ফিল করতে পারতাম। আপনার ওখানে বসে মনে হচ্ছিল এখানটায় আছে, এখন মনে হচ্ছে নাই।
-কোনো বিষয় নিয়ে প্রবল দুঃশ্চিন্তায় থাকলে এমনটা হতে পারে। অতিরিক্ত ‘টেনশন’ বা উদ্বেগে ভোগা একধরনের সমস্যা। একে অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার বলা হয়। আপনি নিজেকে যথাসম্ভব রিলাক্সড রাখুন, এরকম কিছু ভাবুন যাতে আপনার মন রিলাক্সড থাকে।

সাবিহার আবার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। মা সব সময় রিলাক্সড থাকতেন। বাবা কিছু খুঁজে না পেলেই অস্থির হয়ে যেতেন, দেখাগেলো একটু পরই মা সেটা খুঁজে বের করে দিচ্ছেন। মা বলতেন, কোনো কিছু খোঁজার সময় সব জায়গায় খোঁজাখুঁজি না করে, নিজেকে নিয়ে ভাবতে, আমি কোথায় কোথায় গিয়েছি, কি কি করেছি। তাহলেই বের হয়ে আসবে আমি কোথায় ফেলে এসেছি। কেউ যদি নিয়ে যায় তাহলে পাবি না, আর যদি না নিয়ে যায় তাহলে নিশ্চই পাবি। তাহলে কি মায়ের চাদরটা কেউ নিয়ে গেছে, অন্য কোনো ফ্লোরে, কেবিনে বা আইসিইউ তে, কিংবা অপারেশন থিয়েটারে ? সাবিহা যখন এসব ভাবছিলো তখন অনেকগুলো ভাঁজ করা চাদর নিয়ে একজন ঢুকলো। টেবিলের উপর রেখে, রতন বাবুকে উদ্দেশ্য করে , স্যার এখানে ৫০টা আছে, আমি গুনে দেখছি। রতন বাবু একটা টালি খাতায় টুকে রাখে।
সাবিহা চাদরগুলোর উপর হাত রাখে। খেয়ালের বসে একটা চাদর টেনে বের করে। ভাঁজ খুলতেই চাদরের কোনায় অস্পষ্ট মা লেখা দেখতে পায়। নিজের হাতের লেখা চিনতে ভুল হয় না। খুঁজে পাবার আনন্দ, আর হারানোর বেদনা দুটো একসঙ্গে মিশে সাবিহার চোখে জলের ধারা নামে। আরে এটাইতো সেই চাদর, দেখেন, এই যে মা লেখা, আমি নিজে লিখছিলাম। রাফি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে, সত্যিই সেখানে মা লেখা।

MD IMRAN HOSSAIN
MD IMRAN HOSSAINhttps://themetropolisnews.com/
Md. Imran Hossain, a certified SEO Fundamental, Google Analytics, and Google Ads Specialist from Bangladesh, has over five years of experience in WordPress website design, SEO, social media marketing, content creation, and YouTube SEO, with a YouTube channel with 20K subscribers.

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

3,800FansLike
300FollowersFollow
250SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles