back to top
21.9 C
New York
Tuesday, July 2, 2024

TMN Shop

spot_imgspot_img

চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল, ২০২২ – ডিএনএ বিন্যাসে মানবজন্মের ইতিহাস


চিকিৎসক না হয়েও এ বছর চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পেয়েছেন সুইডিশ গবেষক ও জিনতত্ববিদ ডঃ সাভান্তে পাবো। কে এই পাবো? কতটা তাৎপর্যপূর্ণ তার এই কাজ? জন্মসূত্রে সুইডিশ আর কর্মসূত্রে জার্মানিতে বসবাসরত পাবোই সর্বপ্রথম দক্ষিণ এশিয় আর ইউরোপীয়দের কোভিড-১৯ রোগে অত্যধিক মৃত্যুর হার ও রোগের তীব্রতার তারতম্যর জন্য জিনগত সম্পর্কের হদিস পেয়েছিলেন। তাঁর কাজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে নোবেল কমিটির অন্যতম সদস্য অ্যানা ওয়েডেল বলেছেন এ একেবারেই অসাধ্য সাধন

 

 

আমাদের বর্তমান মানব প্রজাতিকে বলা হয় হোমো স্যাপিয়েন্স। হোমো বলতে দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারে এমন প্রজাতিকে বোঝায়। এক কালে পৃথিবীতে বর্তমান মানব প্রজাতি তথা হোমো স্যাপিয়েন্স ছাড়াও হোমো হাইডেলবার জেনেসিস, হোমো হাবিলিস, হোমো ইরেক্টাস, হোমো রুডলফেন্সিস, হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস, হোমো নিয়ান্ডারথালেন্সিস, হোমো নালেডি, আর হোমো লুযোনেন্সিস সহ আরো অনেক প্রজাতির বসবাস ছিল। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে আমরা হোমো স্যাপিয়েন্সরাই শুধু টিকে আছি স্বগৌরবে। বাকি সব প্রজাতি ডাইনোসরের সঙ্গী হয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে কালের অতলে। কিন্তু কৌতুহলী মন জানতে চায় কেমন ছিল অন্য সকল মানব প্রজাতি। আর কেনই বা তারা বিলুপ্ত হল। 

 

জার্মানির লিপজিগে অবস্থিত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউট অফ ইভোল্যুশনারি অ্যানথ্রোপলজির প্রতিষ্ঠাতা ডঃ পাবো তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন এসব প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে। ২০১০ সালে তাঁর নেতৃত্বে একটি গবেষক দল নিয়ান্ডারথালদের পরিপূর্ণ জিনোমিক সিকোয়েন্স বের করে ফেলে, যা ছিল আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব একটি কাজ, বিশেষত যেখানে হাজার বছর ধরে ব্যাকটেরিয়া আর ফাঙ্গাসের প্রভাবে ডিএনএ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। এটি পাবোর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কাজ হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া তিনি রাশিয়ার সাইবেরিয়ার এক গুহায় পাওয়া হাড়ের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে সম্পূর্ণ নতুন এক প্রজাতির সন্ধান পান, গুহার নাম অনুযায়ী যার নাম দেয়া হয় ডেনিসোভা হোমিনিন বা ডেনিসোভান। আমাদের হোমো বা দ্বিপদীগণের জাতভাই ছিল এই ডেনিসোভান আর নিয়ান্ডারথালরা। এদের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে ডঃ পাবো দেখিয়েছেন আমরা কিভাবে এই দুই প্রজাতি থেকে আলাদা। আবার আমাদের মিলই বা কোথায় কোথায়। 

 

ডেনিসোভান আর নিয়ান্ডারথালরা কোথায় বসবাস করত, তাদের আকার-আকৃতি কেমন ছিল, তারা কিভাবে নাই হয়ে গেল, আর আমরাই বা কিভাবে টিকে গেলাম বা আমাদের সাথে তাদের কোন মিশ্রণ হয়েছিল কি না এগুলো সম্পর্কে জানা যায় পাবোর গবেষণার মাধ্যমে। বর্তমান মানব জাতি হোমো স্যাপিয়েন্সের বিকাশ হয়েছিল আফ্রিকায়। আর নিয়ান্ডারথালদের বিকাশ হয় আজকের ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু কিছু এলাকায়। হোমো স্যাপিয়েন্স যখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তখন নিয়ান্ডারথালদের সাথে তাদের দেখা হয়, ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষমতার লড়াইও হয়। আবার এদের মধ্যে প্রজননের ফলে জেনেটিক্যাল অদল-বদলও হয়। মজার ব্যাপার হল সাধারণত ভিন্ন দুই প্রজাতির মধ্যে মিলনের ফলে অনুর্বর বাচ্চার জন্ম হয়, যেটা এখানে হয় নি। কেন হয় নি তার উত্তর লুকিয়ে আছে জেনেটিক্যাল গঠনে। তাই আমরা বলতে পারি সেই ছোট বেলা থেকে শিশু মনে দোলা লাগানো প্রশ্ন “মাগো, কোথা থেকে কেমন করে এলাম আমি” – এর উত্তর দিতে হলে পাবোর কাজ নিয়ে জানতেই হবে এবং তার কাজ নিয়ে আরও গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। তার এই কাজ এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ যে এখান থেকে বিজ্ঞানের নতুন একটা বিভাগেরই জন্ম হয়েছে যার নাম “প্যালিও জিনোমিক্স”।

 

এক প্রজাতির জিনকে যদি আরেক প্রজাতির জিনের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়, একে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় জিন ফ্লো। ধারণা করা হয় যে ঠিক এই ব্যাপারটাই ঘটেছে আমাদের সাথে নিয়ান্ডারথাল আর ডেনিসোভানদের। ১৯৮৬ সালে সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সনদ অর্জন করা পাবো তার গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে আমাদের দেহে এই দুই বিলুপ্ত প্রজাতির সরাসরি প্রভাব রয়েছে। এর উদাহরণস্বরূপ বলা যায়

 

  • ডেনিসোভান EPAS1 জিনের প্রভাবে তিব্বতের মানুষেরা অধিক উচ্চতায় কম অক্সিজেন যুক্ত পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে।

 

  • নিয়ান্ডারথাল HYAL2 জিনের প্রভাবে প্রায় ৫০ শতাংশ পূর্ব এশিয়রা (চীন, মঙ্গোলিয়া, জাপান, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান) সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিতেও ভালভাবে টিকে থাকতে পারে। 

 

  • নিয়ান্ডারথাল POU2F3 জিনের প্রভাবে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পূর্ব এশিয়দের চামড়ার সবচেয়ে বাহিরের স্তর ক্ষত সারার ক্ষেত্রে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়।

 

  • নিয়ান্ডারথাল BNC2 জিনের প্রভাবে প্রায় ৭০ শতাংশ ইউরোপীয় এবং কিছু এশিয়র গায়ের রং ধবধবে সাদা এবং এতে মেছতার মত ছোপ ছোপ দাগ রয়েছে। এছাড়াও এরা তীব্র ঠান্ডা আবহাওয়াতেও টিকে থাকতে পারে। 

 

  • নিয়ান্ডারথাল STAT2 জিনের প্রভাবে প্রায় ৫ শতাংশ ইউরোশিয় এবং ৫৪ শতাংশ পাপুয়ানদের বিশেষ রোগ প্রতিরোধ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

 

  • TLR1, TLR6, TLR10 জিন, যার অন্তত একটি ডেনিসোভান আর ২ টি নিয়ান্ডারথালদের থেকে এসেছে, এদের বিভিন্ন প্রকারের বিন্যাসের প্রভাবে বিভিন্ন জায়গার মানুষের শরীরের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস এবং পরজীবীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন জিনের নিয়ান্ডারথাল ধারার কারণে মানুষের মধ্যে হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক হ্রাস পায়, যার কারণে পেপটিক আলসার ও পাকস্থলীর ক্যান্সারের মত রোগ হতে পারত। আবার এই একই জিনের প্রভাবে মানুষের মধ্যে হে ফিভার বা অনবরত হাঁচির মত অ্যালার্জি জনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। 

 

ছবি ১: হোমো স্যাপিয়েন্স, ডেনিসোভান আর নিয়ান্ডারথালদের কঙ্কালের গঠনের তুলনামূলক চিত্র।

 

ছবি ২: হোমো স্যাপিয়েন্স, ডেনিসোভান আর নিয়ান্ডারথালদের মাথার খুলির গঠনের তুলনামূলক চিত্র।

 

ডিএনএ আমাদের কোষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। মানুষ, উদ্ভিদ, জীবাণু বা প্রাণীকূলের সকল প্রজাতির নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। তা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে বহন করে নিয়ে যায় এই ডিএনএ। একটি মানব শিশু জন্মের সময় যে সকল বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়, বয়সের সাথে সে পরিপূর্ন মানব থেকে বৃদ্ধ, তারপর মৃত্যু হলেও তার ডিএনএ বিন্যাস একই রকম থেকে যায়। আর প্রজননের মাধ্যমে তার পরবর্তী প্রজন্মের মাঝেও এই বৈশিষ্ট্যগুলো ছড়িয়ে পড়ে যদি না কোন কারণে তার মধ্যে কোন মিউটেশন বা পরিবর্তন হয়। তাই বলা হয় ডিএনএ বিশ্লেষণ করলে যে কারো সম্পর্কে সমস্ত ধরণের শারীরবৃত্তীয় তথ্য বের করা সম্ভব, জানা সম্ভব তার দাদার দাদার দাদা কেমন ছিল। তারমানে জিনোমিক সিকোয়েন্স হল আলীবাবার গুহার চিচিং ফাঁকের মত বন্ধ কোন দরজা যেটা খুলতে পারলে জানা যায় পৃথিবীর সকল প্রজাতির অতীত কে। আর যেহেতু ডিএনএগুলো মিউটেশন না হলে একই বিন্যাস মেনে চলে, ফলে ভবিষৎ কেমন হতে পারে তারও একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে। শুধু তাই  নয়, পিতৃত্ব নির্ণয় পরীক্ষা, রোগব্যাধি নিরুপণ বা মেডিকোলিগ্যাল বিভিন্ন বিষয়ে জেনেটিক বিশ্লেষণের অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। 

 

বিভিন্ন সংক্রামক রোগের গবেষণার ক্ষেত্রে পাবোর কাজ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। কিছু দিন আগে বুবোনিক প্লেগ রোগের জীবাণু নিয়ে গবেষণা করে জানা যায় যে চতুর্দশ শতকে প্রায় ১ কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী এই জীবাণুর কিছু স্ট্রেইন এখনো বিদ্যমান। পাবো এবং তাঁর গবেষক দলের উদ্ভাবিত পদ্ধতি ব্যবহার এই বুবোনিক প্লেগের জিনের বিন্যাস বিশ্লেষণ করে এর গতি প্রকৃতি পুরোটাই উন্মুক্ত করা গেছে। নোবেল পুরস্কার বাদেও বহু সম্মানসূচক পুরস্কারে ভূষিত হওয়া ডঃ পাবোর গবেষণা এভাবেই করোনার গতি-প্রকৃতি বোঝার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ২০২০ সালে বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালের এক নিবন্ধে হুগো যিবার্গ আর সাভান্তে পাবো প্রকাশ করেন যে যাদের শরীরে নিয়ান্ডারথালদের জিন রয়েছে, তারা কোভিড-১৯ ভাইরাসে তুলনামূলক তীব্রভাবে আক্রান্ত হয়েছে। এসব কারণেই চিকিৎসক না হয়েও চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পেলেন তিনি। যার মাধ্যমে খুলে গিয়েছে মানুষের উৎপত্তি ও প্রজাতি সংক্রান্ত গবেষণার নতুন দরজা।

 

ডাঃ সঞ্চারী কুন্ডু একজন ডাক্তার এবং সমাজকর্মী

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

3,800FansLike
300FollowersFollow
250SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles