ছবিঃ মোঃ সাকের উদ্দিন আরিফ
মোঃ আশিকুর রহমান তালুকদার নিবিড় –
দেশের প্রাচীনতম, সর্ববৃহৎ এবং উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। আজ থেকে প্রায় ১০১ বছর আগে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঐতিহ্যবাহী এ বিশ্ববিদ্যালটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তন আগামী ১৯ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত হবে। একইসঙ্গে অধিভুক্ত ঢাকা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজের জন্য ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস এবং ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজের জন্য ইডেন মহিলা কলেজ ক্যাম্পাস ভেন্যুতে এই সমাবর্তন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
গত ২৬ আগস্ট ২০১৯ হতে ১৩ অক্টোবর ২০২২ পর্যন্ত বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ গ্র্যাজুয়েটরা এই সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
সমাবর্তনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর জনাব মো. আবদুল হামিদ সভাপতিত্ব করবেন। আর সমাবর্তন বক্তা হিসেবে থাকবেন নোবেল বিজয়ী ফরাসী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. জ্যাঁ তিরোল। বাজার শক্তি এবং বড় বড় কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিশ্লেষণমূলক গবেষণার জন্য তিনি ২০১৪ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
সমাবর্তন বলতে আমরা সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি বলে বুঝে থাকি। সমাবর্তন শব্দটি ইংরেজি কনভোকেশন (Convocation) শব্দের বাংলা অনুবাদ। এটি ল্যাটিন ভাষা থেকে এসেছে। এই দিনে শিক্ষা কার্যক্রমের সমাপন শেষে ছাত্রছাত্রীদের সনদপত্র তুলে দেয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বপ্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এতে বাংলার তৎকালীন গভর্নর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড লিটন সমাবর্তন বক্তব্য প্রদান করেন। এরপর ১৯২৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়ে ব্রিটিশ আমলের ২৪ তম এবং শেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালের ২১ নভেম্বর।
পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ। এই সমাবর্তনেই কার্জন হলে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সেই কুখ্যাত “উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা” ভাষণ দিয়েছিলেন যার প্রতিবাদে সমাবর্তন স্থলেই তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং ছাত্ররা দাঁড়িয়ে নো নো বলে তীব্র প্রতিবাদ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন আরো অনেক বেগবান হয়ে উঠে। ১৯৫২ সালের সমাবর্তনের তারিখ নির্দিষ্ট ছিল ২৪ ফেব্রুয়ারি কিন্তু মহান ২১ ফেব্রুয়ারির মর্মান্তিক ঘটনায় পর এটি আর অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এটি পরে সে বছরেরই ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়।
আবার ১৯৬৪ সালের সমাবর্তনও ছিল এক পণ্ডময় সমাবর্তন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সেবারই প্রথম বারের মত প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে চ্যান্সেলর আবদুল মোনায়েম খান ও উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম ওসমান গনির সমাবর্তন প্রদান করার কথা থাকলেও মোনায়েম খানের কাছ থেকে ডিগ্রি নিতে ছাত্র-ছাত্রীরা অস্বীকার করলে এটি পণ্ড হয়ে যায়।
পাকিস্তান আমলে সর্বশেষ সমাবর্তন হয় ১৯৭০ সালে ৮ মার্চ; সেটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম সমাবর্তন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত মোট ১৫ বার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়।
স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো (৪০তম) সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাবর্তন উদ্বোধন করার কথা ছিল; কিন্তু তার আগেই ভোররাতে ঘটে যায় স্মরণকালের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড যার ফলে তখন সমাবর্তন স্থগিত করা হয়।
স্বাধীনতার দীর্ঘ ২৮ বছর পেড়িয়ে বাংলাদেশে প্রথম সমাবর্তন (৪০তম) অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর। এরপর সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ২০০১, ২০০৪, ২০০৭, ২০০৮, ২০০৯, ২০১২, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫, ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৮তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৩ সালে। এটি সমাবর্তন ইতিহাসের এক অনবদ্য সংযোজন, কারণ প্রধান বক্তা ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী প্রথমবারের মত সম্পূর্ণ বাংলায় সমাবর্তন ভাষণ দিয়েছিলেন।
২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল ৪৮তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউরোপীয় অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ (সার্ন)-এর মহাপরিচালক অধ্যাপক রোল্ফ হুয়ের। তাকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি ৪৯তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তা ছিলেন জেনেভাভিত্তিক মেধাস্বত্ব সংগঠন ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের মহাপরিচালক ফ্রান্সিস গ্যারি।
২০১৭ সালের ৪ মার্চ ৫০তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিও’র প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক অমিত চাকমা। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তাকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর ৫১তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবর্তনে বক্তা হিসেবে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।
সর্বশেষ, ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২ তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে ছিলেন জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর কসমিক রে রিসার্সের পরিচালক এবং নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. তাকাকি কাজিতা। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তাকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি প্রদান করা হয়।