Previous image
Next image
মোস্তফা খালেদ অভি –
উত্তরখণ্ডের ভেতরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৩৫৮ ফিট উচ্চতায় কুমায়ূন হিমালয়ের পাদদেশে রাজধানী দেরাদুন শহর থেকে ৩৪৫ কিলোমিটার দূরে কুমায়ূন বিভাগের প্রশাসনিক সদরদপ্তর শৈলশহর নৈনিতাল স্থানীয়দের কাছে পরিচিত দেবভূমি হিসেবে।
নৈনিতালের লোককথা অনুযায়ী নৈনিতাল নামকরণের পেছনের যে ঘটনাটা পাওয়া যায় সেটা হলো, বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্রের সাহায্যে সতীকে ধ্বংস করেন। সেই সময় ভগবান শিব দুঃখে কাতর হয়ে সতীর মৃত শরীর নিয়ে সমগ্র জগৎ ঘোরেন, ফলে সতীর দেহের অংশবিশেষ পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে পতিত হয়। লোককথায় প্রচলিত আছে যে, দেহত্যাগের পর সতীর চোখ বা নয়ন নৈনি হ্রদে পতিত হয় । তাই এখানে নয়না দেবী মন্দির স্থাপন করা হয়। হ্রদের দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত এই মন্দিরটি স্থানীয় মানুষের কাছে নৈনি মাতা মন্দির হিসেবেই পরিচিত।
শহর হিসেবে নৈনিতালের ইতিহাসও বেশ পুরোনো। লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় দশম শতকে বিখ্যাত কাত্যুরী সাম্রাজ্যের পতনের পরে থেকে। এই শহরকে প্রথম গোছানো একটা রূপ দেয় নৈনিতালের খাসিয়া পরিবার। আর তারপর ১৪৩৩ সাল থেকে চান্দ্ সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ নৈনিতাল অঞ্চলে রাজত্ব শুরু করে। পরবর্তীকালে ১৮১৪-১৬ ব্রিটিশ-নেপাল যুদ্ধের পরে ইংরেজরা সমগ্র ভারতের মতো কুমায়ূন অঞ্চলেও শাসন শুরু করে। ১৮৪১ সালে ইংরেজ শাসনের তত্ত্বাবধানেই সম্পূর্ণ আধুনিকভাবে নৈনিতাল শৈলশহরের উৎপত্তি ঘটে।
নৈনি হ্রদকে কেন্দ্র করে রয়েছে সাতটি পাহাড়ের চূড়ার অবস্থান। এগুলো হলো – আয়ার্পাতা, দেওপাতা, হান্ডি বান্ডি, চিনা পিক, আলমা, লারিয়া কান্তা, শের কা ডান্ডা । এই হ্রদটি মূলত দুইটি খণ্ডে বিভক্ত, যার উত্তরের অংশটি মল্লিতাল এবং দক্ষিণের অংশটি তাল্লিতাল নামে নামকরণ করা হয়েছে। হ্রদের পাড়েই রয়েছে নৈনি দেবীর মন্দির।
নৈনি হ্রদের পাশ দিয়ে চলে গেছে মল রোড। আর মল রোড শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে যায় বাজার। নৈনিতাল বাজারে সবচেয়ে জনপ্রিয় মোমের তৈরি জিনিস আর হাতের কারুকাজ করা নানা স্থানীয় ডিজাইনের শোপিস যেসব আপনি ওই মল রোডের বাজারেই দেখতে পাবেন। এখানে মোটরবাইক ও সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। আপনি চাইলেই নিজেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারেন পাহাড়ি রাস্তা অন্বেষণে। রাতের নৈনিতাল বেশ সুন্দর। পাহাড়ের প্রতি খোপে খোপে বাড়ি। পাইন, দেবদারু গাছে ঘেরা এই অঞ্চল।
স্থানীয় ভাষায় “তাল” শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো লেক বা হ্রদ। সাতটি শৃঙ্গের পাশাপাশি নৈনিতাল অঞ্চলে রয়েছে সাতটি তাল। ভীমতাল, সাততাল, নাউকুচিয়াতাল, খুরপাতাল, মালয়াতাল, হরিশতাল এবং লোখাতাল। সাতটি তালের মধ্যে ভীমতাল ও সাততাল এই অঞ্চলের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। পুরো নৈনিতালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার সর্বোত্তম উপায় হলো নির্মল হ্রদ ভ্রমণ।
নৈনিতালের সর্বোচ্চ পাহাড়ের চূড়া এবং সবচেয়ে সুন্দর স্থানগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে নয়না পিক। ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধের পর শিখরটির নাম পরিবর্তন করে চায়না পিক থেকে নয়না পিক করা হয়। উচ্চতা এবং সবুজ বুনো পথের কারণে, নয়না পিক ট্র্যাকিংয়ের জন্য একটি জনপ্রিয় জায়গা। গাড়িতে বা ক্যাবল কারে আপনি এর শিখরে পৌঁছতে পারেন। ক্যাবল কার মল্লিতাল থেকে শুরু হয় আর স্নো ভিউ পয়েন্টের সাথে সংযোগ করে। এখানে একমুখী যাত্রায় তিন মিনিটেরও কম সময় লাগে।
উত্তরখণ্ডের আরেক অবশ্য গন্তব্য হচ্ছে বিখ্যাত নিম করোলি বাবার আশ্রম। এটি নৈনিতাল থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । নিম করোলি বাবা একজন সাধু। মানুষের সেবাকেই ঈশ্বরের ভক্তির সর্বোত্তম মাধ্যম বলে মনে করে তিনি কৈচিধামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৬০ এবং ৭০-এর দশকে তিনি তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। সেই সময় অনেক আমেরিকান আর ইউরোপীয় ভারতে এসে নিম করোলি বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং তাঁর থেকে দীক্ষা নেন। বাবা নিম করোলি ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মারা যান। মার্ক জাকারবার্গ, স্টিভ জবসের মতো বেশ কয়েকজন নামিদামি টেক জায়েন্ট বিভিন্ন সময়ে এই আশ্রমে এসে কিছুটা সময়ে কাটিয়ে গিয়েছেন। লেখক রাডিয়ার্ড কিপলিং এবং জিম করবেট তাঁদের রচনাতে বারবার নৈনিতালের কথা উল্লেখ করেছেন। জিম করবেট এখানেই বাস করতেন। সুন্দর পাহাড়ঘেরা চিরশীতল এই শহরের জন্য থাকবে এক রাশ ভালোবাসা।
মোস্তফা খালেদ অভি দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ এবং জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র।