Previous
Next
মেট্রোপলিস প্রতিবেদন –
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর স্বদেশী আন্দোলনের সময় বৃটিশ বিরোধী ডাকে যখন বিদেশী পোশাক বয়কট করা হয় তখন খাদি কাপড় হয়ে ওঠে অখন্ড ভারতের জাতীয়তার প্রতীক। “স্বদেশী পণ্য গ্রহণ কর আর বিদেশী পণ্য বর্জন কর” এই স্লোগানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে খাদির বিশাল বাজার। ইংরেজদের চড়া মূল্যের বিদেশী কাপড় বয়কট করে দেশে খাদির বাজার বা বোনা কাপড়ের বাজার তৈরীর উদ্দেশ্যে গান্ধী “নিখিল ভারত চক্র সংঘ” প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের কুমিল্লায় রয়েছে খাদির সেই বাজারের অবশেষটুকু। কুমিল্লার চান্দিনা, মুরাদনগর ও দেবিদ্বারে সহস্রাধিক তাঁতশিল্প রয়েছে।
এই খাদির ইতিহাস কিন্তু উপনিবেশ সময়ের থেকেও পুরাতন। ১২০০ সালে বিখ্যাত ইটালিয়ান পরিব্রাজক মার্কোপোলো খাদিকে বর্ণনা করেন মাকরশার জালের থেকেও সুক্ষ্ণ কাপড় হিসেবে। এছাড়া খাদি মসলিনের সমাদর ছিল রোমে। ইরিথ্রিয়ান সাগর দিয়ে প্রচুর পরিমাণে কাপড় সে সময়ে রপ্তানী হত ইউরোপে।
এই চাহিদা কে ধরে রাখার জন্য ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর তৎকালীন কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ও বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা ড. আখতার হামিদ খান তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নুনের সহযোগীতায় “দ্য খাদি এন্ড কটেজ ইন্ড্রাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন” প্রতিষ্ঠা করেন। তখন কুমিল্লার অভয়াশ্রমে, চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘ, আর নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রমে খাদি বা খদ্দর কাপড় বোনা হতো।
ড.আখতার হামিদ খান প্রতিষ্ঠিত “দি খাদি কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড” এর হাল ধরেন চান্দিনার শৈলেন গুহ ও তার ছেলে বিজন গুহ। তারা এই খাদিশিল্পের সুনাম ছড়িয়ে দেয়ার জন্য অনবরত কাজ করে গেছেন। শৈলেন গুহ মারা যাবার পর তার ছেলে বিজন গুহ এ শিল্পকে ধরে রাখছেন কোন মতে। চান্দিনাতে মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি বিজড়িত একটি তাঁতশিল্প রয়েছে আজও। ১৯৯৪ সালে কুমিল্লার খাদিশিল্প গুণগত মানের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়।
তুলা থেকে চড়কায় তোলা সুতা থেকে খাদি কাপড় বোনা হয়। হাতে বোনা হয় বলে খাদি কাপড় খুব মসৃন হয় না। তবে খাদি কাপড় অত্যন্ত আরামদায়াক, বিশেষ করে বাংলাদেশের মত ক্রান্তিয় জলবায়ুতে যেই “মিষ্টি শীত” পড়ে সেই শীতের জন্য খাদি কাপড় খুবই উপযোগী। ভারী ছাড়াও পাতলা খাদি কাপড়ের তৈরী পোশাক এই অঞ্চলের প্রচন্ড গরমের জন্য খুবই উপযোগী। পাতলা খাদির ক্ষুদ্র ফাকা অংশ বা পারফোরেশনের কারণে আর্দ্রতা বেশী হলেও খাদি কাপড় পড়ে স্বাছন্দ পাওয়া যায়। তুলা ছাড়াও সিল্ক বা উলের সুতা থেকেও খাদি কাপড় তৈরী হয়।
“পিরান বাংলাদেশ” যাত্রার শুরু থেকেই ঐতিহ্যবাহী দেশীয় কাপড়ের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছে। ইতিহাস আর পূর্বসুরীদের গৌরব গাথা তাদের উৎসাহের উৎস। সেইসাথে যুগের চাহিদাগুলোকে ডিজাইনের সাথে নিগমবদ্ধ করার চেষ্টা থেকে শীতের এই খাদি কালেকশন তৈরী হয়েছে। খাদি শাল, জ্যাকেট, পঞ্চ এর পাশাপাশি রয়েছে উলের শাল। এসকল ফ্যাব্রিকের সাথে যুক্ত হয়েছে নাগরিক জীবনের উৎসাহে আঁকা শিল্পকর্ম থেকে তৈরী করা প্রিন্ট। “শহরের হারানো জঙ্গল” থিমের এবস্ট্রাকট আর্ট আর অতি পুরানো ইতিহাসের টেক্সটাইলের মেলবন্ধনে তৈরী হয়েছে তাদের শীতের পোশাকের সমারোহ।
বর্তমানে অন্যান্য আরও অনেক ঐতিহ্যের মত খাদিও হারিয়ে যাচ্ছে। কুমিল্লার দক্ষ তাঁতিদের মধ্যে প্রায় সবাই পেশা বদলে ফেলেছেন জীবিকার তাগিদে। অল্পসংখ্যক যারা টিকে আছেন তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কেউ জীবিকা হিসেবে আর এই শিল্প বেছে নিচ্ছেন না। এর পিছে সবচেয়ে বড় কারণ হল কাঁচামাল তুলার সংকট। বর্তমানে ভারত, চীন, আমেরিকা থেকে আমদানিকৃত সুতা থেকে তাঁতে খাদি বুনার চেষ্টা চলছে। চড়কায় বুনা সুক্ষ সুতা থেকে খাদি তৈরির ঐতিহ্য এখন আর নেই বললেই চলে। বাজারে অনেক স্বল্প মূল্যে আমদানিকৃত কাপড় পাওয়া যাচ্ছে যার ফলে খাদির চাহিদাও অনেক কমে গেছে। এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজন খাদি গবেষণায় যথাযথ সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। খাদির গুণগত মানোন্নয়ন, তাঁতিদের প্রশিক্ষণ এবং উন্নত কাঁচামালের পর্যাপ্ত সরবরাহই এই খাদি শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারে।