ছবিঃ নেচার এন্ড ফার্মিং
রাশিদুল ইসলাম ও মাসুম হোসেন –
বর্তমান সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা একটি বেশ আলোচিত বিষয়। কোভিড ১৯ মহামারী এবং এর পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন, বিপণন এবং বণ্টন ব্যবস্থায় বেশ বিরূপ প্রভাব পড়েছে। খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল দেশগুলোর অন্যতম হওয়া সত্বেও এখানে এখনও ঝুঁকি হিসেবে রয়ে গেছে ইঁদুরের আক্রমন।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে প্রাপ্য তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকার সমমূল্যের ৭ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য কেবল ইঁদুরই নষ্ট করে থাকে যা দেশের অন্তত ৫০ লক্ষ মানুষের ১ বছরের খাবারের সমতুল্য।
দেশে এ বছর রোপা আমন ধানের বাম্পার ফলন হলেও ইঁদুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে কৃষকেরা। ইঁদুর দমনে সরকারি ও বেসরকারিভাবে কৃষিজমিতে নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করেও সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। উৎপাদনের একটি বড় অংশ গিলে ফেলছে ইঁদুর নামের ক্ষুদে রাক্ষস ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খুলনার অতিরিক্ত পরিচালক (শস্য) মোছাদ্দেক হোসেন বলেন, “বছরের ধানের মোট উৎপাদনের প্রায় ৮ শতাংশ নষ্ট করে ইঁদুরসহ অন্যান্য ক্ষতিকর পোকামাকড়। এর মধ্যে ইঁদুরই বেশি ধান খেয়ে ফেলে।” তিনি আরও বলেন, “জমিতে ৭ শতাংশ ধানের ক্ষতি করে ইঁদুর। পরে গুদামজাত শস্যে আরও ১ শতাংশ ক্ষতি করে। তবে ইঁদুর দমনে আমার নানামুখী কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। কৃষকদের সচেতন করতে প্রচার-প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যার সুফল পাওয়া যাচ্ছে। এ কাজে উৎসাহ দেয়ার জন্য জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কৃষকদের পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
বগুড়ার কাহালু উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা এসএম আল-আমিন দ্য মেট্রোপলিসকে বলেন, “প্রয়োজন অনুযায়ী নানা কৌশল অবলম্বন করে ইঁদুর নিধন করা যায়। বিভিন্ন ফাঁদ পেতে বা গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর ধরে পিটিয়ে মেরা ফেলতে হবে। গুদামে বা ঘরে এক প্রকার আঠা কাঠের বোর্ড, টিন ও মোটা শক্ত কাগজে লাগিয়ে ইঁদুর চলাচলের রাস্তায় ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায় । তবে লোভনীয় খাবারের প্রলোভন দিতে হবে। বিষটোপের মাধ্যমে ইঁদুর নিধন করাও সহজ। একবার বিষটোপ খেলেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মারা যায় ইঁদুর।”
তিনি আরও বলেন, “এছাড়াও প্যাঁচা, শিয়াল, বেজি, বন বিড়াল, সাপ, গুঁইসাপ, বিড়াল দিয়েও ইঁদুর নিধন করা যায়। এসব ইঁদুরভোজী প্রাণীর বংশবিস্তারের মাধ্যমে ইঁদুরের কবল থেকে রক্ষা পাবে কৃষকের ফসল।”
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে প্রাপ্য তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশ – যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইসরাইল, জর্ডান, মালয়েশিয়া ও হাঙ্গেরী – মাঠ ফসলের ইঁদুর দমনে প্যাঁচার ব্যবহার করছে। এজন্য তারা প্যাঁচার প্রাকৃতিক পরিবেশকে সংরক্ষণের পাশাপাশি এর প্রজনন ও প্রতিপালন কার্যক্রমকে কৃষক পর্যায়ে উৎসাহিত করছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গিয়েছে যে, একজোড়া প্যাঁচা চার মাসের একটি প্রজনন চক্রে ৪ থেকে ৬টি বাচ্চার লালন-পালনে ৫০-৭০ গ্রাম ওজনের প্রায় ৩০০০ থেকে ৫০০০ পর্যন্ত ইঁদুর ভক্ষণ করতে পারে।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম দ্য মেট্রোপলিসকে বলেন, “আলো চলাচল করে এমন স্থানে ইঁদুর থাকতে পারে না। এজন্য আবাদি জমি সবসময়ই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ইঁদুর নিধনের কৌশলগুলো অবলম্বন করতে হবে। ইঁদুর সবচাইতে বেশি গমের ক্ষেতে ক্ষতি করে। কারণ সেখানে সহজে আলো-বাতাস যেতে পারে না।”
তিনি আরও বলেন, “ইঁদুর দমনে কৃষকদের সবসময়ই পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া স্কুল-কলেজে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা হচ্ছে। সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় ইঁদুর নিধন সম্ভব হবে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইনসাদ ইবনে আমিন বলেন, “ইঁদুর এ এলাকার কৃষকদের এখন প্রাধান শত্রু। ইঁদুর ফসলের অনেক ক্ষতি করে। বিশেষ করে ধানের কচি ও পাকা শীষ কেটে ফেলে। এছাড়াও গাছের কাণ্ড তেরছা করে কেটে দেয় ইঁদুর। আমার কৃষকদের সচেতন করতে বাড়িতে মাঠে ঘাটে প্রচার করে থাকি । তবে বিগত দিনের চেয়ে কৃষকরা এখন অনেক সচেতন।”
পাবনার সুজানগর উপজেলার কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, ধানের জমি ও গুদামে ইঁদুর নিধনের জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফেড (ট্যাবলেট) ব্যবহার করাসহ নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। ইঁদুরের গর্তে একটি ট্যাবলেট ফেলে দিলে ক্ষেতের ওই জায়গার ইঁদুরগুলো মারা যায়। এতে ইঁদুরের অত্যাচার কমলেও ধান শতভাগ বাঁচানো যায় না। যত চেষ্টাই করা হোক না কেন, ইঁদুর ফসলের ক্ষতি করেই।
বিগত ১৯৮৩ সাল থেকে প্রতি বছর দেশে ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালিত হয়। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মো. এনামুল হক বলেন, “প্রতিবছরেই জুলাই মাসে আমরা ইঁদুর নিধন কার্যক্রম শুরু করি। এ কার্যক্রম মাসব্যাপী চলে। এ বিষয়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়। তারা মাঠ পর্যায়ে কৃষকের সঙ্গে নিয়ে ইঁদুর নিধন করেন। এ কার্যক্রমে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাও অংশ নেন। ইঁদুর নিধনের মাস শেষে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। যিনি সর্বোচ্চ ইঁদুর নিধন করবেন তাকে পুরস্কৃত করা হয়। এ প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণকারীদের ইঁদুর মেরে লেজ সংগ্রহ করে জমা দিতে বলা হয়।”
ইঁদুর দমন করে পুরস্কার প্রাপ্ত কৃষক খুলনার ডুমুরিয়া খলসী গ্রামের মাসুদ রানা শান্ত বলেন, “ইঁদুর ও ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনে জমিতে নানা পদ্ধতি ব্যবহার করেও ফসল রক্ষা করা যাচ্ছে না। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি করেই যাচ্ছে ইঁদুর। আমরা বিষটোপের মাধ্যমে ইঁদুর দমন করে থাকি। তবে এটা নির্মূল করা কঠিন। এ ব্যাপারে সবার এগিয়ে আসতে হবে।”
ইঁদুর নিধনে আরেক পুরস্কার বিজয়ী ডুমুরিয়ার কৃষক সেলিম উল ইসলাম বলেন “বিলের ধানের আবাদী জমির আইল ও মাছের ঘেরে ইঁদুরের উপদ্রব বেশি। ইঁদুর নিধনে আমরা গমের টোপ ব্যবহার করি। তবে এতে পুরোপুরি ইঁদুর দমন হয় না। একযোগে সব কৃষক ইঁদুর নিধনে অংশ নিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।”
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট থেকে প্রাপ্য তথ্য অনুযায়ী, আমন মৌসুমে নিরাপদ আশ্রয়স্থল, পর্যাপ্ত খাদ্য এবং পানি সহজলভ্য হওয়া এবং মৌসুমের শেষভাগে বৃষ্টিপাত কম ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ সময়ে ইঁদুরের প্রজনন খুব বেশি হয়। ফলে ইঁদুরের সংখ্যা অন্যান্য মৌসুমের তুলনায় বেড়ে যায়। ইঁদুরের প্রজনন শুরুর পূর্বেই ইঁদুর নিধন করা দরকার। তাই আমন মৌসুমে ইঁদুর দমনের উপযুক্ত সময় ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক। কারণ এ সময়ে মাঠে ইঁদুরের সংখ্যা কম থাকে। মাঠে প্রচুর খাদ্য না থাকায় ইঁদুর সহজেই এ সময় বিষটোপ খেয়ে থাকে। আমন ফসল ক্ষতি করার আগেই ইঁদুর মারতে পারলে এদের সংখ্যা বৃদ্ধি কম হয় এবং ফসলের ক্ষতিও অনেক কম হয়ে থাকে। ধান রোপণের সময় ও রোপণের ৪৫-৫০ দিনের মধ্যে ধানের জমি ও আশপাশের এলাকার ইঁদুর দমনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
তেরখাদা কৃষক আসলাম হোসেন বলেন, “আমরা যে পরিমাণ ইঁদুর নিধন করি তার চেয়ে জন্ম নিচ্ছে অনেক বেশি। যে কারনে নির্মূল করা সম্ভব হচ্ছে না।” ইঁদুর খুব চতুর ও দ্রুত বংশ বিস্তারকারী প্রাণী। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, ১ জোড়া ইঁদুর তার জীবদ্দশায় প্রায় ৩ হাজার বংশধর সৃষ্টি করতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর খুলনার অতিরিক্ত পরিচালক মোঃ ফরিদূল হাসান বলেন, “খুলনা অঞ্চলে ঘেরের বেড়িবাধ ও জমির আইলে এজন্য আবাদি জমি সবসময়ই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ইঁদুর নিধনের কৌশলগুলো অবলম্বন করতে হবে। ইঁদুর সবচাইতে বেশি ধান ও গমের ক্ষেতে ক্ষতি করে।” তিনি আরও বলেন, “ইঁদুর দমনে কৃষকদের সবসময়ই পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে কর্মী ও কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করা হচ্ছে । যার সুফল পাওয়া শুরু হয়েছে। ইঁদুর নিধন অভিযান অব্যাহত থাকবে।”