back to top
7.9 C
New York
Sunday, December 29, 2024

TMN Shop

spot_imgspot_img

রবিনহুডের কাজীদা

রবিনহুডের কাজীদা

সাব্বিরুল হক –

এক 

“ইংল্যান্ডের নটিংহাম শহরের কাছেই ছিল বিশাল শেরউড জঙ্গল। সেই জঙ্গলে আস্তানা গেড়েছিল দুর্দান্ত দুঃসাহসী এক মহৎ হৃদয় দস্যু – রবিনহুড ও তার সাত কুড়ি দুর্ধর্ষ অনুচর। অত্যাচারী নর্মান শাসক, প্রজা-নিপীড়ক জমিদার, অসৎ ব্যবসায়ী আর অর্থ-লোলুপ বিশপ-মোহান্তদের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছিল রবিন; কিন্তু আবার লুন্ঠিত অর্থ দীন-দুঃখীদের মধ্যে বিতরণের মাধ্যমে জয় করে নিয়েছিল সাধারণ মানুষের অন্তর। বিপদে সাহায্য চেয়ে কেউ কোনদিন ফিরে আসেনি তার দুয়ার থেকে। আসুন, লেখকের সাথে গিয়ে আমরাও ঘুরে আসি গভীর গহীন সেই শেরউড জঙ্গল থেকে।”

কাজী আনোয়ার হোসেনের রবিনহুড

কী অদ্ভুত আকর্ষণ আর অজানা রোমাঞ্চের হাতছানি কাহিনী সংক্ষেপটায়! যে সময় বইটা সদ্য বেরিয়েছে, মাত্র ক্লাস সিক্স নাকি সেভেনে পড়ি। ঘুরে ঘুরে হাতে এসে পড়েছে বড়দের কিনে আনা সেবা প্রকাশনীর স্বাস্থ্যবান বই রবিনহুড। আমার জন্যে দ্বিতীয় চমক অপেক্ষা করছিল ভূমিকাতেই। পড়ে হয়ে গেছি হতবাক, সাথে মুগ্ধ-বিহ্বল। 

একটা বই ছেলে বয়সের মনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে এর অনন্য উদাহরণ হতে পারে বইটা। রবিনহুড নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক বই। হয়েছে মুভি/টিভি সিরিজ। কিন্তু সেসবের কিছু মনে দাগ কাটতে পারেনি। কারণ সেবা প্রকাশনীর এই বই পড়ার পর বইয়ের বর্ণনায়ই সব সময় রবিনহুডকে কল্পনা করেছি। মনে পড়ছে লিটল জনের সাথে রবিনের প্রথম দেখার কথা। নটিংহামে ধোঁকা দিয়ে রবিনের তীর প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার কথা, সেই সাথে শেরিফকে লেখা স্মরনীয় ছড়াটা। 

“ভেবেছিলে ধরবে তাকে/পড়বে ফাঁদে রবিনহুড/পুরস্কারটা কে নিল আজ/হাসছে তামাম শেরউড।”

সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে, প্রথম কোন বই পড়ে কেঁদে কেটে বালিশ ভাসাবার কথা। সংগ্রহের প্রিয়তম বইটা চুরি করল যে তার উপর রাগ করলেও রুচির প্রশংসা করেছি এটাও বেশ মনে পড়ে।। ইলাস্ট্রেটেড ছবিগুলো চোখে ভাসে এখনও।

দুই

রবিনহুড কি কল্পনাই শুধু? নাকি ওর বাস্তব অস্তিত্বও ছিল? ইতিহাসবিদরা মনে করেন রবিনহুড কাল্পনিক চরিত্র নয়। রবিনহুড বলে সত্যি এক যোদ্ধা ছিল। তবে ওর কাহিনীটা হয়তো সেভাবে লেখা হয়নি। তাই একেক গল্পে একেকভাবে উঠে আসে সেগুলো। রবিনের জন্ম নিয়েও পাওয়া যায় নানান তথ্য। উনিশ শতকে ইংল্যান্ডের অনেকে মনে করতেন স্যার ওয়াল্টার স্কটের আইভানহো প্রকাশের পর রবিনহুডের সন্ধানে যাত্রা শুরু হয়েছিল। ওয়াল্টার স্কট রবিনহুডকে চিহ্নিত করেন রাজা রিচার্ডের অনুসারী হিসেবে।

ইতিহাসবিদ জোসেফ হান্টার রবিনহুডকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন। সব থেকে পুরানো রেফারেন্স পাওয়া যায় ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার থেকে। ১২২৬ সালে আদালতে তালিকাভুক্ত রবিনহুড নামে এক ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যায়। এরপর ১২৬২ সালে দক্ষিণ ইংল্যান্ডের বার্কশায়ারে উইলিয়াম রবহোড নামে আরেক ব্যক্তির হদিস মেলে। ১৩৫৪ সালে নর্থশায়ারের উত্তর কারাগারে রবিনহুড নামে একজন বন্দি ছিল বলে জানা যায়, অপেক্ষা করছিল ন্যায় বিচারের।

নটিংহামে রবিনহুডের ভাস্কর্য

উনিশ শতকের ইতিহাসবিদরা রবিনহুডের নামে বিভিন্ন রেকর্ড আবিষ্কার করেছিলেন। বেশিরভাগ গবেষক একটা ব্যাপাওে একমত ছিলেন- সম্ভবত ঐতিহাসিক রেকর্ডে এমন কোন ব্যক্তি ছিল, যা রবিনহুড সংক্রান্ত লোকপ্রিয় গল্পকে অনুপ্রাণিত করেছে। রবিনহুড কবে জন্মেছে এর সঠিক তারিখ, সন জানা না গেলেও ওর অস্তিত্বের খোঁজ পাওয়া যায় ১৩৭৭ সালে। 

ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত প্রাচীন পান্ডুলিপি অনুযায়ী রবিন জন্মগ্রহণ করে ১১৬০ সালে দক্ষিণ ইয়র্কশায়ারের লকারবি শহরে। শহরটা বর্তমানে লক্সলি নামে পরিচিত। আরও কিছু কাহিনীতে জানা যায় রবিনের জন্ম আরও পরে।

তিন 

পঞ্চদশ শতাব্দীর দিকে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন লোকগল্প, কবিতা উপন্যাসে দেখা যায় রবিনহুডকে নিয়ে লিখতে। উইলিয়াম ল্যাংলয়েড এর বই ‘দ্য ভিশন অব পিয়ারস পলোম্যান’ দ্বিতীয় খন্ডে রবিনহুডের উল্লেখ আছে। ওখানে গরিব-দুঃখী মানুষকে সাহায্য করতে দেখা গেছে এই নায়ককে। অশিক্ষিত-নিঃস্ব মানুষের মুখে মুখে তখন ঘুরে ফিরে রবিনহুডের নাম। ছড়ায় ছড়ায় গানে গানে রবিনহুড নামটা আসছে শিশু-বৃদ্ধ সবার মুখে। ভিশন বইটা এমনভাবে রবিনহুডকে বর্ণনা করা হয়েছে যেটা পড়ে মনে হতেই পারে রবিনহুডের অস্তিত্ব নিশ্চয়ই ছিল। আর লেখক সেটা স্পষ্ট জানতেন। 

মধ্যযুগের আরও সাহিত্যকর্মে রবিনহুডের কীর্তির খবর বেরিয়েছে। এসব সাহিত্যকর্ম প্রথমবারের মত এক জায়গায় করা হয় ‘আ গেস্ট অব রবিনহুড’ নামে এক ব্যালাডে। ব্যালাডটি রচিত হয়েছিল ষোড়শ শতকের দিকে। ব্যালাডের স্তবকের ভেতর দিয়েই মূলত ফুটিয়ে তোলা হয়েছে রবিনের বীরত্বের কথা। আজ পর্যন্ত এ-নিয়ে যত গবেষণা করা হয়েছে, সেসবের অন্যতম সূত্র হিসেবে এই ব্যালাডকেই গোণায় রাখা হয়।

চার 

কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখা কিংবদন্তির বইটাতে দস্যু নেতা হলেও রবিনহুড ইংল্যান্ডের সেরা তীরন্দাজ। শুরুতে বলা হয়েছে কীভাবে রবিন দস্যু হয়ে উঠেছিল। কেমন করে ওর সাথে পরিচয় হয়েছে একে একে লিটল জন যে কিনা রবিনের সব থেকে বিশ^স্ত অনুচরে পরিণত হয়েছিল, আর্থার, উইল স্কারলেট যে রবিনের আপন ভাগ্নে কিংবা মিজ দ্য মিলারের। 

এরপর নটিংহামের শুটিং, রবিনের প্রথম দিকের বন্ধু উইল স্টিউটলির ফাঁসি, শেরিফের শেরউডের ভোজ, সুমধুর কণ্ঠের গায়ক অ্যালান-এ-ডেলের সাথে পরিচয় ও তার প্রেমিকার সাথে বিয়ে, শেরউডের জন্য যাজক সন্যাসী টাকের সাথে পরিচয়, এক দুঃখী নাইটের সাহায্য, রবিনের ছোটবেলার বন্ধু মেরিয়ানের সাথে দেখা, দুঃখী নাইটের ঋণ পরিশোধ, রানীর সম্মানে ইংল্যান্ডে শুটিংয়ে অংশ নেয়া, রবিনের পালানো, রবিনকে হত্যা করার জন্য শেরিফের পাঠানো গাই অভ গিসবানের সাথে লড়াই, রাজার শেরউডে আসা, রবিনের বন্দী হওয়া, আর সব শেষে রবিনের শেষ তীর ছোঁড়া। কী নেই বইটাতে! 

রবিন অসহায় লোকের বন্ধু আবার অত্যাচারীর ত্রাস, পুরো ইংল্যান্ড জুড়ে ওর চেয়ে ভাল কোন তীরন্দাজ নেই, লাঠিয়াল নেই। সে যে তীর ছোঁড়ায় সবার সেরা তার প্রমাণ দিয়েছে বারবার। অর্থ কড়ি লুট করে তা আবার দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার মহৎ কাজ তো আর একা করা সম্ভব নয়, তাই সে খুঁজে খুঁজে বের করেছে এমন সব লোক যারা কেউ তীর ছোঁড়ায়, কেউ বা লাঠি খেলায় ও অন্যান্য কাজে পারদর্শী। 

দস্যুতা করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সে স্থানীয় শেরিফের চোখে পড়ে যায়। কুটিল শেরিফ রবিনহুডকে হত্যা করে রাজার কাছে নিজের ক্ষমতা জাহিরের জন্য সংকল্প নেয়। শেরিফের হাতে বারকয়েক রবিন ও সহযোগিরা ধরা পড়লেও বেঁচে যায়। রবিনের এই বীরত্বের কথা শুনে রাজা স্বয়ং ছদ্মবেশে এসে হাজির হন রবিনের ডেরায়। কিন্তু রবিন আর ওর সহযোগিদের সততা ও শৃঙ্খলা দেখে মুগ্ধ হয়ে ফেরেন। 

মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, হয়তো কোন এক কালে সত্যি সত্যিই রবিনহুড নামের এক দস্যু ছিল প্রাচীন ইংল্যান্ডে। যেহেতু লোকমুখে প্রচারিত হয়েছে ওর কাহিনী, সেহেতু সেসব যে একেবারে আদি অকৃত্রিম অবস্থায় রয়েছে তা ভাবাটা ঠিক হবে না। তবে এসব কিছু বাদ দিয়ে নির্ভেজাল আনন্দ পেতে ক্ল্যাসিক কিশোর হিসেবে পডলে রবিনহুডের রহস্যময় চরিত্রের সাথে অ্যাডভেঞ্চারাস কাহিনীর মধ্যে নিজেকে নিয়ে যেতে পারা আনন্দ পুরোপুরি পেয়েছি কাজীদার রবিনহুড। এই প্রাপ্তিটাই আমার মনে হয়েছে – আসল কথা ।

পাঁচ 

আরও বলার আছে কাজীদার রবিনহুড নিয়ে। বইটা তিনি এমন করে লিখেছেন যা সারাক্ষণ আপনাকে উত্তেজনার মধ্যে রাখবে। কাজী আনোয়ার হোসেনের রহস্য-রোমাঞ্চ বোনার যাদু পরতে পরতে পাবেন। রবিনের দুর্দান্ত রোমাঞ্চকর অ্যাডভেঞ্চার জানতে গিয়ে সেবার এই বই না পড়লে আমি মনে করব কৈশোরটাই বিফল ছিল।

কাজীদার লেখনিতে কথনও মনে হয়নি এটা কোন বিদেশী বইয়ের ছায়া বা অনুবাদ। মনে হয়েছে বাংলা ভাষায় লেখা কোন বীর আউট-লয়ের গল্প বুঝি পড়ছি। রবিনহুড বইটা হাতে পেয়েছি অনেক আগে। বলতে গেলে সবে পল্পের বই পড়তে শিখেছি যে সময়টায়। আসলে তখনই নিরেট ভক্ত হয়ে গেছি কাজী আনোয়ার হোসেন এর। আজও তাঁর লেখা পড়ে খুঁজে পাই অতল বিস্ময়। তাই রবিনহুড বইটা কখনও ফের হাতে নিলে রবিনের নয়, আমার বরং কাজীদার কথাই মনে পড়ে আগে।

সাব্বিরুল হক একজন আইনজীবি এবং লেখক। 

MD IMRAN HOSSAIN
MD IMRAN HOSSAINhttps://themetropolisnews.com/
Md. Imran Hossain, a certified SEO Fundamental, Google Analytics, and Google Ads Specialist from Bangladesh, has over five years of experience in WordPress website design, SEO, social media marketing, content creation, and YouTube SEO, with a YouTube channel with 20K subscribers.

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

3,800FansLike
300FollowersFollow
250SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles