বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৪০.৬ ভাগ মানুষ কৃষিকাজে নিয়োজিত। এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে পাওয়া সর্বশেষ জরিপের ভাষ্য। এদেশের কৃষিব্যবস্থার একধরনের চিরাচরিত নিজস্ব নিয়ম ছাড়াও বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় এদেশে কৃষির অবস্থা বেশ সমৃদ্ধ। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে তৃতীয়। ধান, গম, আলু ও ভুট্টার বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। নিবিড় চাষের মাধ্যমে বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে আর মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সেরা চারটি দেশের মধ্যে অবস্থান করছে। শুধু তাই নয়, ফলমূল চাষেও এদেশ দেখিয়েছে আশার পথ। জাতীয় ফল কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে ২য়, আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারায় অষ্টম হওয়াটা সেই প্রমাণ দেয়।
এ বছরের শুরুতে জানা যায় দারুন তথ্য। বাংলাদেশ ২০২১ সালে দেশের ১৬৭টি চা-বাগান এবং ক্ষুদ্রায়তন চা-বাগান থেকে রেকর্ড ৯৬,৫০৬ টন চা উৎপাদন করেছে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। পাশাপাশি মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিপুল সাফল্য অর্জন করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে ২৪ হাজার ২২৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছরে এই খাতে বাজেটের পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা, যা সংশোধিত বাজেটে দাঁড়িয়েছিল ১৮হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা।
এসবই আশার কথা, সম্ভাবনার কথা, মাথা উঁচু করে বাঁচার কথা। কিন্তু যারা এই এত এত রেকর্ড গড়ার মূল কারিগর, রোদ-ঝড়, বৃষ্টিতে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, যাদের ফোঁটায় ফোঁটায় চুইয়ে পড়া ঘামের বিনিময়ে পাওয়া এসব অর্জন সেই কৃষকরা পাচ্ছেন তো তাদের শ্রমের ন্যায্য মজুরী? কোন অভিমানে নিজের কষ্টার্জিত ক্ষেতের ফসল পুড়িয়ে দিচ্ছেন? কেন ঋনের দায়ে কৃষক দম্পতি আত্নহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন? মূলত, শহরের ধনী ও মধ্যবিত্ত যে খাবার খায়, তা কৃষকের ভর্তুকির ফসল। বছরের পর বছর মানুষের মুখে খাবার তুলে দেবার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করা কৃষকরা লাভের মুখ দেখার বদলে লোকসান গুনেই চলেছেন। এদিকে প্রতি বছর লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েই চলেছে কৃষি কাজের উৎপাদন ব্যয়।বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘুর্ণিঝড় সহ সকল প্রাকৃতিক দূর্যোগে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাওয়াটা আরো কঠিন হয়ে পড়ে। আর দীর্ঘ মেয়াদী করোনার কারণে বর্তমান অবস্থাটি যে আরও নাজুক, সে তো বলাই বাহুল্য। তার উপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে বয়ে যাওয়া সিত্রাং যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা।
করোনার অভিঘাত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট সংকটময় পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত দেশে কৃষকের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ মোটেও কম নয়। এই ক্ষতির পরও খাদ্য চাহিদা মেটাতে চাষাবাদ বন্ধ করেননি কৃষকরা। তবুও সেই উপকারী, কিন্তু অসহায় কৃষকের ওপরও চেপেছে করের বোঝা। আয়কর অধ্যাদেশ আইন ১৯৮৪ অনুযায়ী কৃষকের পক্ষে ব্যক্তিগত আয়ের ওপর আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত অব্যাহতি দেয়া থাকলেও এ সুবিধা পাওয়ার জন্য কৃষকের আয়কর প্রত্যাবর্তন-অব্যাহতির সনদ থাকা প্রয়োজন। নাহলে কৃষকের পণ্যে অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ অর্থাৎ মোট ৩ শতাংশ উৎসে কর কেটে নেয়া হবে। দেশে যেখানে খুব বেশি হলে ৩০ লাখ মানুষ আয়কর রিটার্ন দাখিল করে, সেখানে গ্রামের কৃষকরা কীভাবে কর সনদ নেবে আর রিটার্ন দাখিল করবে সেটি আবারো ভেবে দেখা জরুরী।
কৃষকরাই দায়িত্ব নেন জমি রক্ষণাবেক্ষণ এবং ফসল উৎপাদনের। বাংলাদেশের কৃষকরা সাধারণত আগের বছরের অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তী বছর ফসল ফলিয়ে থেকেন। যদি কৃষক পেঁয়াজের মূল্য কম পেয়ে থাকেন, তবে পরের বছর সেটি উৎপাদন করতে অনাগ্রহী হন। আবার যদি সেটি ফলিয়ে লাভবান হন, তবে অধিকাংশ কৃষক পরের বছর একই ফসল চাষ করতে চান। এর ফলে একই ফসল বেশি উৎপাদনের কারনে চাহিদা কমে যায় এবং সেই ফসলের দাম স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। যদি কৃষকদের কাছে কোন ফসলের কি পরিমান চাহিদা সেটির সুস্পষ্ট ধারনা বা তালিকা থাকতো তবে তাঁরা সেই প্রয়োজন অনুসারে ফসল উৎপাদন করতে পারতেন আর তাতে করে ন্যায্যমূল্য থেকে মোটেও বঞ্চিত হতেন না এবং বাড়তি ফসল নষ্ট হতো না।
এদেশের কৃষিমন্ত্রী একজন কৃষিবিদ বিধায় তাঁর কাছে আমরা কি এতটুকু আশা করতে পারিনা যাতে তিনি এমন ধরনের মনিটরিং সেল গঠন করেন যাতে করে প্রান্তিক চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি পণ্য ক্রয় করা যায় আর তাতে যুগ যুগ ধরে চলে আসা মধ্যসত্বভোগীদের শোষণের হাত থেকে কৃষক সমাজ কিছুটা হলেও মুক্ত হবে। একইসাথে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মত ফসলের ভবিষ্যৎ বাজারের দাম ও চাহিদা কেমন হতে পারে সেটির সম্ভাব্য ধারনা কৃষককে দেয়া হলে তাঁরা লোকসানের হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেতেন। যে কোন ধরনের দূর্যোগে চাষীদের ফসল নষ্ট হবার বিপরীতে বীমা ব্যবস্থা থাকার পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলায় পূর্ব পরিকল্পনা থাকা জরুরী।
একইসাথে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করতে কৃষকের হাতে সরাসরি নগদ অর্থে প্রণোদনা দেওয়া, দুর্যোগকালীন সময়ে যেকোন কৃষিপন্য ক্রয়ে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রনালয়ের মধ্যে সমন্বয় করা, বর্গা চাষিদের ঋণ নয় বরং সরাসরি প্রণোদনা দিয়ে কৃষি উৎপাদনে উৎসাহ দিতে নীতিমালা প্রনয়ন করা, কৃষি যন্ত্র উৎপাদনে দেশীয় উৎপাদকদের প্রণোদনা দেয়ার জন্য বরাদ্দ রাখা এবং পারিবারিক কৃষির প্রসারে বাজেট বরাদ্দের দাবি কি অনেক বেশি চাওয়া? করোনা ভাইরাস কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে গোটা বিশ্বের অর্থনীতির বেহাল দশা হবার কারণে যদি এখনো কৃষক ক্ষতির মুখে পড়েন, তাহলে এবার তা গোটা জাতিকে ভোগাবে সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই অনুরোধ, কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ কথাটির মর্মার্থ উপলব্ধি করে কোটি মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে কৃষক বান্ধব দেশ গড়ে তুলুন।
তানজিনা আকতারী দ্য মেট্রোপলিসের উপ সম্পাদক