ছবিঃ সুজন রহমান ও তার মা তাসলিমা বেগম
নওশিন ইয়াসমিন –
সন্তানের ভালোর জন্য মায়েরা কত কিছুই না করেন। কি করলে সন্তানের ভাল হবে সেই চেষ্টা মায়েরা সব সময়ই করে থাকেন। সন্তান যদি পরিপূর্ন সুস্থ না হয় তাহলে মায়েদের কষ্ট ও পরিশ্রম আরো বেড়ে যায়। তেমনি এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে সফল হতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন এক মা তাসলিমা বেগম। পুরোপুরি হাতে ধরে শিশুকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত চলছে প্রাণান্তকর লড়াই। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছেলে সুজন রহমানকে করিয়েছেন স্নাতকোত্তর। সেইসাথে গুনী সংগীতশিল্পী, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পীও সুজন ।
একই সাথে গান লেখা ও সুর করার বিরল প্রতিভাও আছে সুজনের। ইসলামী গান, পল্লীগীতি, নজরুল সংগীত, ভক্তিমূলক সহ নানা রকম গান গেয়ে চলেছেন, দিয়েছেন সিনেমার গানে কন্ঠ, গেয়েছেন মৌলিক গান। তার থেকেও বড় কথা ছোট থেকে এ পর্যন্ত সুজনের অর্জনের ঝুলিতে জমা হয়েছে ৩৫টির বেশি জাতীয় পর্যায়ের পুরষ্কার। সুজনের এই কঠিন পথচলাকে সহজ করেছেন তাঁর মা। তাইতো সুজন অকপটে বলেন, আমি আজ যা কিছু সব হয়েছে আমার মায়ের চেষ্টায়।
চাকুরী জীবনে সুজন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, কুষ্টিয়ার জেলা সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। ছেলের সফলতার পথপ্রদর্শক হয়ে যাবতীয় কষ্টের স্বীকৃতি মিলেছে এ মায়ের। রাজধানীর মিরপুরে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে ২৮তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ও ২১তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস ২০১৯ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সফল পিতামাতা ক্যাটাগরিতে একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে তাসলিমা পুরষ্কার গ্রহণ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে।
অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া অবস্থায় বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর কখনও স্কুলে যাওয়া হয়নি তাসলিমা বেগমের। নিজের কাছে নিজেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন, কখনো যদি মা হতে পারেন, সন্তানদের অবশ্যই শিক্ষিত করে তুলবেন। বিয়ের ৩ বছরের মাথায় কোল আলো করে জন্মায় বড় সন্তান সুজন রহমান। সন্তান সুস্থ সবল থাকলেও যখন সুজনের বয়স মাত্র দেড় বছর তখন ডায়রিয়ার আক্রমণে চোখের দৃষ্টি হঠাৎ করে কমে যায়। খুব কাছে না এলে কাউকেই দেখতে পারতো না সে। শুরু হলো সন্তানকে সুস্থ করে তোলার জন্য চেষ্টা, ছুটোছুটি, এক কঠিন লড়াই। নিজ জেলা ছাড়িয়েও যে যেখানে চিকিৎসকের সন্ধান দিয়েছেন, ছুটে গেছেন সেখানেই। কিন্তু ছেলের চোখের দৃষ্টি ফেরানো যায়নি আর।
ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করানোর পর মূল যুদ্ধের ময়দানে প্রবেশ করলেন তাসলিমা। তবে এ যুদ্ধে জেতার জন্য নিজের স্বামী ও মাকে সবসময় পাশে পেয়েছেন তিনি। সেই সাথে ছোট মেয়ে মৌ এর অবদান ও মোটেই কম নয় বলে জানান তিনি। ছেলের লেখাপড়ার পাশাপাশি গান শেখাতে উদ্যমী হলেন তিনি। শিশু থেকে স্নাতকোত্তর, অডিশন, শিল্পকলাএকাডেমি, শিশুএকাডেমি, গানের শিক্ষক, স্টেজ, স্টুডিও থেকে শুরু করে চাকুরি সব জায়গায় সুজনের সাথে তিনি ছিলেন ছায়া হয়ে।
সারাদিনের কাজের ফাঁকে নিজে পড়ে শোনাতেন তাঁকে, সুজন তখন ব্রেইল পদ্ধতিতে নিজের মত করে শুনে শুনে লিখেনিত। কথায় কথায় বললেন, ‘’জানো, আমার মনেহয়, সুজন আমার চোখ দিয়েই দেখে। আমি দুচোখে যা দেখি, যে ভাবে দেখি ঠিক সেই ভাবেই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ননা ছেলেবেলা থেকে দিয়ে এসেছি ওকে। ছোটবেলা থেকেই দারুন মেধাবি আমার ছেলেটা। সে যেটাই করার চেষ্টা করেছে সেটাই সফলভাবে করে দেখিয়েছে। একবার কি হয়েছে জানো, সুজনের গানের অডিশন দিতে ঢাকা যাচ্ছি লঞ্চে চেপে। সুজন জানতে চাইলো, মা লঞ্চ দেখতে কেমন? আমি পুরো লঞ্চের সামনে থেকে পেছন পর্যন্ত কোথায় কি আছে বললাম। কুষ্টিয়া ফিরে শক্ত কাগজ কেটেকুটে কিভাবে কিভাবে সে একটা লঞ্চের আকৃতি দিয়ে ফেলল। না দেখেও সে শুধু বর্ননা শুনে এমন অনেক কিছু বানিয়ে দিতে পারতো অনায়াসেই।‘’হাসতে হাসতে জানান’’। ২ সন্তানের বাবা হয়ে গেলেও এখনো সুজন বাইরে যাবার সময় জানতে চায়, মা দেখোতো এই জামাটাতেই মানাচ্ছে নাকি অন্যটা পড়বো?
কর্মজীবনে তাসলিমার স্বামী ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকোর ভ্রাম্যমান কর্মচারী ছিলেন। বছরের ৪-৫ মাস কাজ করতেন অফিসে বাকি সময়তো বসে থাকা। এই সময়ে চেষ্টা করতেন ছোটখাটো নানান কাজ করার। তাই সেই অর্থে কখনোই স্বচ্ছলতার মুখ দেখা হয়নি তাঁর। স্বামীর সাথে নিজেও তুলে নিয়েছিলেন সংসারের দায়িত্ব,করেছেন সেলাইয়ের কাজ। জানালেন, এমন অনেক হয়েছে, সুজনকে নিয়ে ঢাকা গেছি সকালে, কুষ্টিয়া ফিরেছি মধ্য রাতে, সেলাই করে, সংসারের কাজ গুছিয়ে আবার পরদিন ঢাকা রওনা দিয়েছি, কিন্তু সুজনের গান বা লেখাপড়ার কোন ক্ষতি হতে দেইনি। ছোট মেয়েটার প্রতি যত্ন কম নিতে পারলেও স্নাতকোত্তর করাতে ভুলিনি। জীবনের ৫৫ বছরে এসে মনে হয়, কষ্টটা হয়তো বিফলে যায়নি।
ফোনের অপরপ্রান্তেও বেশ বুঝতে পারছিলাম খুশির কান্নায় কন্ঠ বেশ ভার তাসলিমার। তার মাঝেও হাসির রেশ টেনে বলেন, কলকাতা থেকে সুজনের এক ভক্ত শুধু কে সুজনের মা সেটি দেখার জন্য কুষ্টিয়ায় চলে এসেছিল। অনেকেই আমাকে যখন দেখতে চায়, কথা বলে, মনে হয় আমি সত্যিকারের সফল মা,আর এটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।