হাসিব ইসলাম জিহান –
বিংশ শতাব্দীর শুরুর সময়টা পদার্থবিজ্ঞানের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। রহস্যময় বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য এই সময়ে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পাশাপাশি নিলস বোর আর ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বেরও আবির্ভাব হয়।
আলবার্ট আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন যে কোন বাস্তব অবস্থা বর্ণনা করার জন্য সুনির্দিষ্ট এবং সঠিক পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন। কিন্তু নিলস বোর এর সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেছিলেন কোন কোয়ান্টাম মিথস্ক্রিয়াই সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় না। বরং বাস্তব অবস্থা বর্ণনা করার জন্য কোয়ান্টাম মিথস্ক্রিয়া ঘটার সম্ভাবনা কেমন হতে পারে সেই সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণীর প্রয়োজন। এই বাস্তব অবস্থার সংজ্ঞা এবং নির্ণয়পদ্ধতি নিয়ে ১৯৩০ এর দশকের বিজ্ঞানমহল দৃশ্যতই আইনস্টাইন বনাম বোর-শ্রোডিঙ্গার এই দুই মহলে বিভক্ত ছিল।
আইনস্টাইন মনে করতেন আমরা দেখি বা না দেখি যে কোন বাস্তব অবস্থার প্রতিটি অংশেরই একটি স্বতন্ত্র এবং সম্পূর্ণ অস্তিত্ব আছে। চাঁদ কিংবা আলোর ফোটন যাই হোক না কেন, সব কিছুরই পরিমাপ করতে পারার মত সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কিন্তু, বোর আর শ্রোডিঙ্গার এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন যে পরিমাপ না করা পর্যন্ত একটি কণার নির্দিষ্ট কোন বৈশিষ্ট্য থাকে না।
কোয়ান্টাম সিস্টেম (বোর) আর ধ্রুপদী পদার্থবিদ্যার (আইনস্টাইন) আচরণের মধ্যে মূল পার্থক্য হল এনট্যাঙ্গলমেন্টের ধারণা। যখন দুটি উপ-পরমাণু কণা পরিপূরক বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরস্পরের সাথে সহাবস্থান করে, তখন একে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট বলে। এ অবস্থায় একটি কণার বৈশিষ্ট্য পরিমাপ করা গেলে অন্য কণার বৈশিষ্ট্যও অনুমান করে নেয়া যায়। অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ এরউইন শ্রোডিঙ্গার সর্বপ্রথম এই ধারণার সূত্রপাত করেন যা থেকে তার বিখ্যাত “বিড়াল প্যারাডক্স” এরও জন্ম হয়।
এই এনট্যাঙ্গলমেন্টের উপস্থিতি প্রমাণ করার জন্য পদার্থবিদ জন ফ্রান্সিস ক্লজার, অ্যালাইন অ্যাসপেক্ট এবং অ্যান্টন জেইলিঙ্গারকে ২০২২ সালে পদার্থবিজ্ঞানের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এই কাজের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল কমিটির সদস্য অধ্যাপক থার্স হ্যান্স হ্যানসন বলেন, “এই কাজটিই মূলত স্পষ্ট করেছে কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলতে আসলে কী বোঝায়”।
আসুন এখন এই এনট্যাঙ্গলমেন্টের ব্যাপারে আরেকটু ভালভাবে জেনে নিই। যদি একটি পদার্থকে ভেঙ্গে দুইটা কণা পাওয়া যায় তাহলে কৌণিক ভরবেগের নিত্যতা অনুযায়ী এর একটির স্পিন -১ হলে (ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরে) আরেকটির স্পিন হবে +১ (ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরে)। আমাদের একপাটি জুতা হারানো গেলে যে পাটি আছে সেটি দেখে যেমন কোন পায়েরটা হারানো গেছে এটা বুঝা যায়, ব্যাপারটা অনেকটাই সেরকম।
এখন মনে করুন দুটি কণা একে অপরের থেকে বেশ কয়েক আলোকবর্ষ দূরত্বে অবস্থিত। যদি আমরা পৃথিবীতে অবস্থিত কণাকে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরতে দেখি, তবে দূরত্বে থাকা অন্যটির সাথে সাথেই জেনে যাওয়ার কথা যে এটিকে ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরতে হবে।
ঠিক এখান থেকেই দ্বিধা-দ্বন্দের শুরু। এখানে তথ্য আলোর চেয়েও বেশী বেগে ভ্রমন করছে, যা কিনা আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুযায়ী অসম্ভব। আইনস্টাইন একে ভৌতিক কান্ড হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। তিনি মনে করতেন এই কান্ডের পিছে গোপন কোন ভ্যারিয়েবলের ভূমিকা রয়েছে। এই ভ্যারিয়েবল আলোকবর্ষ দূরত্বে থাকা কণার অবস্থান ঠিক করে রাখে। তার মানে এখানে আসলে কোন টেলিপোর্টেশনের প্রয়োজন নাই।
আইনস্টাইন তার সহযোগী গবেষক বরিস পোডলস্কি এবং নাথান রোজেনের সাথে কোয়ান্টাম তত্ত্বের এই সমস্যাগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য “ইপিআর প্যারাডক্স” নামে একটি চিন্তা পরীক্ষা তৈরি করেছিলেন। এই তত্ত্ব অনুসারে, দুটি কণা যতই দূরে থাকুক না কেন, একটি এনট্যাঙ্গলড কোয়ান্টাম সিস্টেমে একটি কণার পরিমাপের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে অন্য কণাকে প্রভাবিত করতে পারে।
পরবর্তীতে এ বিষয়ে আরও অনেক তাত্ত্বিক ও পরীক্ষামূলক কাজ হয়েছে। যদিও বর্তমানে অধিকাংশ পদার্থবিদেরাই আইনস্টাইনের মত কোয়ান্টাম তত্ত্বকে ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে দেখার জন্য এই প্যারাডক্স ব্যবহার করেন না। বরং কোয়ান্টাম তত্ত্ব ধ্রুপদী পদার্থবিজ্ঞান থেকে কীভাবে কতটা আলাদা সেটিই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই প্যারাডক্সের মাধ্যমে।
এ প্রসঙ্গে ১৯৬৪ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ডের পদার্থবিদ জন স্টুয়ার্ট বেল একটি চিন্তা পরীক্ষার সূচনা করেন। তিনি “বেলের অসমতা” নামক একটা গাণিতিক সমীকরণ সৃষ্টি করেন – যদি কোন গোপন ভ্যারিয়েবল থাকে, তাহলে যত ভাবেই পরিমাপ করা হোক না কেন এর মাণ একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে বেশী হবে না।
এর মানে হল এই অসমতা বজায় থাকলে বা পরিমাপে নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে মান কম পাওয়া গেলে এটি আইনস্টাইনের গোপন ভ্যারিয়েবল তত্ত্বকে প্রমাণিত করবে। আবার, সংখ্যার মান বেশী পাওয়া গেলে এটি বোর বা শ্রোডিঙ্গারের কোয়ান্টাম তত্ত্বকে প্রমাণ করবে।
বেলের অসমতাকে তত্ত্বীয় অবস্থা থেকে সর্বপ্রথম পরীক্ষাগারে নিয়ে আসেন আমেরিকার লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি এবং ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের পদার্থবিদ জন ফ্রান্সিস ক্লজার। তিনি দেখতে পান যে, ক্যালসিয়াম পরমাণুর উপর একটি বিশেষ ধরণের আলো ফেললে এটি এনট্যাঙ্গলমেন্ট হয়ে থাকা ফোটন বিকিরণ করে। এই ফোটনের মেরু অবস্থান নির্ণয়ের জন্য তিনি উভয় পাশেই ফিল্টার বসান। বেশ কিছু মাপ নেয়ার পর অবশেষে ১৯৭২ সালে তিনি প্রমাণ করতে পারেন যে এর মান বেলের অসমতার চেয়ে বেশী পাওয়া গেছে যা আইনস্টাইনের গোপন ভ্যারিয়েবল তত্ত্বকে নাকোচ করে দেয়।
এই পরীক্ষায় কিছু ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা থাকার দরুন তখনো গোপন ভ্যারিয়েবল তত্ত্বকে সম্পূর্ণ নাকোচ করা সম্ভব হয়নি। দেখা যায় যে, সনাক্ত করা ফোটনগুলি উৎস থেকে উৎপাদিত ফোটনের প্রতিনিধি নমুনা ছিল না (শনাক্তকরণ ত্রুটি)। আবার পরীক্ষার পূর্বে বিবেচিত স্বাধীন উপাদানগুলোকে বাস্তবে পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হিসেবে দেখা গেছে (স্থানীয় ত্রুটি)
এই ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি প্যারিস-সুদ ইন ওরসে-এর পদার্থবিদ অ্যালাইন অ্যাসপেক্ট ১৯৮২ সালে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। নিজের উদ্ভাবিত সরঞ্জাম ও পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি পরমাণু উদ্দীপিত করার একটি নতুন পদ্ধতি তৈরি করেন যাতে এনট্যাঙ্গলমেন্ট হয়ে থাকা ফোটন অনেক বেশি হারে বিকিরণ হয়। এছাড়া এক জোড়া ফোটন বের হওয়ার সাথে সাথেই তিনি পরিমাপ করার মানদণ্ডগুলো পরিবর্তন করে ফেলতে পারতেন। এতে করে ফোটন বের হওয়ার সময়ে যে মানদণ্ড ছিল মূল ফলাফল নির্ধারণে এর আর কোন ভূমিকা থাকার সুযোগ রইল না। এভাবে অ্যাসপেক্ট “বেলের অসমতা” আরও বেশী নির্ভুলভাবে ভাঙ্গতে সক্ষম হন।
ফলাফলে অনেক উন্নতি আসলেও অ্যাসপেক্টের এই পরীক্ষা ঠিক পুরোপুরি সঠিক ফলাফল আনতে পারেনি। কারণ এখানে এনট্যাঙ্গলমেন্টযুক্ত ফোটনগুলো পরস্পর থেকে মাত্র ১২ মিটার দূরত্বে অবস্থিত ছিল। এছাড়া অন্য কিছু কারিগরি সমস্যার সাথে সাথে এখানে কিছুটা স্থানীয় ত্রুটিও রয়ে গেছিল।
অস্ট্রিয়ার ইনসব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ আন্তন জেইলিঙ্গার ১৯৯৮ সালে এই ত্রুটিগুলো পুরোপুরি দূর করতে সক্ষম হন। তিনি একটি বিশেষ স্ফটিকের উপর লেজার ফেলে এনট্যাঙ্গলমেন্টযুক্ত জোড়া ফোটন তৈরি করেন। এরপরে এলোমেলোভাবে পরিমাপের মাপকাঠিগুলো পরিবর্তন করা শুরু করেন। এভাবে জেইলিঙ্গার অসংখ্য পরীক্ষানিরীক্ষা সম্পন্ন করেন যার প্রতিটিই ছিল আগেরটার চেয়ে আরও বেশী নিখুঁত। এভাবে গোপন ভ্যারিয়েবল তত্ত্ব সন্দেহাতীতভাবে ভুল প্রমাণিত হয়।
এই পরীক্ষার এক পর্যায়ে ফিল্টারগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে দূরবর্তী ছায়াপথের সংকেতও ব্যবহার করা হয়। সংকেতগুলি যাতে একে অপরের উপর কোনভাবেই হস্তক্ষেপ করতে না পারে, এখানে সেই ব্যাপারটাই নিশ্চিত করা হয়।
জেইলিঙ্গারের এই সাফল্য ক্লজার আর অ্যাসপেক্টের পরীক্ষার ফল নিখুঁত করার পাশাপাশি তথ্য আদানপ্রদানের জন্য এনট্যাঙ্গলমেন্টযুক্ত কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনেরও বাস্তব প্রয়োগের সূচনা করে।
জেইলিঙ্গার কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি আর কোয়ান্টাম যোগাযোগ ব্যবস্থারও একজন প্রতিষ্ঠাতা। ২০০৬ সালে তিনি স্পেনে পরস্পর থেকে ১৪৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত লা পালমা এবং টেনেরিফের মধ্যে একটি সুরক্ষিত কী (একটি গোপন বার্তা যা বাইরের কেউ বের করার চেষ্টা করলেই নিজে নিজে ধ্বংস হয়ে যায়) স্থাপন করতে একটি এনট্যাঙ্গলমেন্ট-ভিত্তিক কোয়ান্টাম কী ডিস্ট্রিবিউশন (QKD) প্রোটোকল এবং একটি অপটিক্যাল ফ্রি স্পেস লিঙ্ক ব্যবহার করেন।
পরে ২০১৭ সালে তিনি তার প্রাক্তন ছাত্র জিয়ান-ওয়েই পানের সাথে মিলে চীনের মিসিয়াস কোয়ান্টাম যোগাযোগ স্যাটেলাইট ব্যবহার করে পরস্পর থেকে ৭৪০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বেইজিং এবং ভিয়েনার মধ্যে একটি QKD কী (৭৫-মিনিটের ভিডিও কথোপকথন) প্রেরণ করেন। এটি কার্যত দুর্ভেদ্য ক্রিপ্টোগ্রাফির এক নতুন দিগন্ত উম্মোচন করে, যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নীতি দ্বারা প্রমাণিত হয়।
কোয়ান্টাম তথ্যপ্রযুক্তি তথা কোয়ান্টাম কম্পিউটার, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক এবং নিরাপদ কোয়ান্টাম –এনক্রিপ্টেড যোগাযোগের উন্নয়নে এই ৩ জন পদার্থবিদের ভূমিকা অপরিসীম। এরই ধারাবাহিকতায় কোয়ান্টাম ইন্টারনেটের মাধ্যমে দীর্ঘ দূরত্বে অতি-সুরক্ষিত, এনক্রিপ্ট করা যোগাযোগব্যবস্থা এখন বাস্তব রূপ পেয়েছে ।
তাইতো এই কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে নোবেল পদার্থবিজ্ঞান কমিটির সভাপতি অ্যান্ডার্স ইরব্যাক বলেন, “এটি ক্রমশই এখন স্পষ্ট যে একটি নতুন ধরনের কোয়ান্টাম প্রযুক্তি উদ্ভূত হচ্ছে। এনট্যাঙ্গলমেন্ট নিয়ে এবারের বিজয়ীদের কাজ যে কেবল কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মৌলিক প্রশ্নগুলির ব্যাখ্যা দিয়েছে তাই নয়, এর বাইরেও এর গুরুত্ব অপরিসীম”।
হাসিব ইসলাম জিহান একজন বিজ্ঞান লেখক। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে অধ্যায়নরত। তিনি বাংলাদেশ বিজ্ঞান পরিষদের সিনিয়র অলিম্পিয়াড সম্পাদক, মনন একাডেমি এবং রুটস এডু এর পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষক।