নানা কারণে আমাদের গণমাধ্যম এখন কঠিন সময় পার করছে। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও প্রভূত অর্থনৈতিক উন্নতির দরুণ সাম্প্রতিক সময়ে মিডিয়ায় পুঁজি বিনিয়োগ বাড়লেও গণমাধ্যম এখনও গণমানুষের ভরসাস্থল হয়ে উঠতে পারেনি। তাকে বিনিয়োগকারী মালিকপক্ষের স্বার্থই সবার আগে দেখতে হচ্ছে। অন্যদিকে সোশ্যাল মিডিয়ার অতিদ্রুত প্রসারের সঙ্গে আমাদের মূলধারার গণমাধ্যম তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। ফলে পাঠক-দর্শক চলে গেছে ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইন্সটাগ্রামের মতো জনপ্রিয় সামাজিক গণমাধ্যমে। ইউটিউবে চাইলে এখন যেকেউ নিমিষে একটা চ্যানেল খুলে নিজের মনগড়া তথ্য প্রচার করছে। অনেকে আইপিটিভি খুলে প্রচলিত টিভি মিডিয়ার বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়ার চেষ্টা করছে। এছাড়া, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন থাকার কারণে সাংবাদিকরা সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে অদৃশ্য এক চাপ অনুভব করেন। ফলে যুগ যুগ ধরে চলে আসা কাগজের পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলগুলো পাঠক-দর্শক হারিয়ে এক আস্থাহীনতার মধ্যে পড়েছে।
বিজ্ঞাপনদাতা বুঝে গেছে মানুষ এখন আর পত্রিকা পড়ে না ও টিভি দেখে না তাই তারা যেখানে দর্শক আছেন সেই সামাজিক মাধ্যমের দিকে ঝুঁকছেন। আর বিজ্ঞাপন কমে আয় কমার কারণে দারুণ এক সঙ্কটের মুখে পড়তে হচ্ছে দেশের গণমাধ্যমকে। টিকে থাকার জন্য ঘুরে ফিরে মালিকপক্ষের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। আর টাকা দিয়ে মালিকপক্ষ নানা শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। ফলে এক দুষ্টচক্রে আবর্তিত হচ্ছে আমাদের মিডিয়াগুলো।
তারপরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে দিনদিন দেশে মিডিয়ার সংখ্যা বেড়েই চলছে। এটাকে মিডিয়ার স্বাধীনতা হিসেবে বলা হলেও মানুষ কিন্তু আস্থা রাখতে পারছে না এসব গণমাধ্যমে। তাইতো বিদেশে বসে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ সত্য-মিথ্যা জড়িয়ে যেসব তথ্য প্রচার করছে তাই বিশ্বাস করছে। কারণ মূলধারার গণমাধ্যম যখন স্বাধীনভাবে সঠিক তথ্য প্রচার করতে পারে না তখন সমাজে নানা গুজব-গুঞ্জণ ছড়িয়ে পড়ে আর মানুষ তা বিশ্বাসও করে।
মজার বিষয় হচ্ছে, এখন মানুষ খবর পড়লেও বা দেখলে আগে জিজ্ঞাসা করে এ মিডিয়ার মালিক কে? মানুষও বুঝে গেছে মালিকপক্ষের কথা ছাড়া মিডিয়া নড়ে না। তবে সাংবাদিকতায় এ চ্যালেঞ্জ নতুন কিছু নয়। এ পেশায় প্রতিকূলতা ছিল, আছে ও থাকবে। আর এটা জেনেই মানুষ সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে নেয়। পার্থক্যটা হচ্ছে, মিডিয়ার এ সঙ্কট এখন অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে আরো ঘনীভূত হয়েছে।
বস্তুত গণমাধ্যমের আজকের খারাপ সময়ের পেছণে আরো কিছু কারণ রয়েছে। দেশে মিডিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনার পরিধি বেড়েছে। যে গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য সাংবাদিকতা শিক্ষা প্রসারিত হচ্ছে বলে বলা হচ্ছে সেই গুণগণমান কিন্তু মিডিয়ায় বজায় থাকছে না। কারণ সাংবাদিকতা থেকে পাশ করে একটা বড় অংশের ছেলেমেয়ে এখন আর সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিচ্ছে না। অনেকেই আরেকটি সরকারি-কর্পোরেট বা বেসরকারি চাকরির হওয়ার আগ পর্যন্ত কিছুদিন আর্থিক সঙ্কট কাটানোর জন্য সাংবাদিকতাকে স্বল্পকালীন পেশা হিসেবে নিচ্ছে। তারপর সুযোগ বুঝে কেউ বিদেশে, কেউ বিসিএস, কেউ এনজিও বা কেউ কর্পোরেট চাকরিকে পেশা হিসেবে নিয়ে নিচ্ছেন। এতে করে দিনশেষে পেশাটা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কারণ এ সুযোগে অপেশাদার, ধান্দাবাজ ও এজেন্ডা নিয়ে আসা অন্যরা মহান সাংবাদিকতা পেশাকে বিতর্কিত করছে। তাইতো আজকাল চারপাশে অনেক মানুষকেই দেখা যায় তারা তাদের অন্য স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সাংবাদিকতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে পেশাটার প্রতি মানুষের আস্থা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। মোটা দাগে দেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
তবে এতোসব খারাপ খবরের মধ্যে ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়। কিছু কিছু গণমাধ্যম এখনও স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে এখনও সাংবাদিকতা পেশার ঝান্ডা ধরে আছে। তারা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল প্লাটফর্ম গঠনের মাধ্যমে পাঠক ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আসলে উন্মক্ত তথ্য প্রচারের এ যুগে মানুষ দশ জায়গা থেকে দশটা তথ্য হয়তো নেবে কিন্তু দিনশেষে সবাই কিন্তু ঠিকই বস্তুনিষ্ট সংবাদটা খুঁজে নেবে। কারণ মানুষকে বেশিদিন ভুল তথ্য দিয়ে অন্ধকারে রাখা যাবে না। আর ইন্টারনেটে এ সময়ে তো আরো সম্ভব না।
তাই যারাই সঠিক, বস্তুনিষ্ট ও সুসাংবাদিকতার চর্চা করবে দেরিতে হলেও তারাই টিকে থাকবে। কারণ গত এক যুগে হাঁকডাক করে অনেক মিডিয়া আসলেও আস্তে আস্তে পাঠক আস্থাহীনতায় অনেকেই হারিয়ে গেছে। সামনে হয়তো আরো অনেক মিডিয়া আসবে আবার অনেকেই মুখ থুবড়ে পড়বে। এভাবেই ভালোরা টিকে থাকবে।
কবির হোসেন একজন যোগাযোগকর্মী