back to top
3.2 C
New York
Saturday, November 23, 2024

TMN Shop

spot_imgspot_img

মন মানুষ

মন মুকুরে ময়ূর নাচে! নূপুরের নাচতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে বাস্তবায়নের জন্য নুপুর ঘরের বড়সড় আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘরে ডিমলাইটের অস্ফুট আলো। অস্ফুট আলোতেও আয়নায় প্রস্ফুটিত নিজের রূপ দেখে নুপুর! 

নূপুরের সারাদেহে সৌন্দর্যের কোন বিশ্রাম নেই! সারাক্ষণ তাকে ঠিকরে পড়তে হচ্ছে কুন্তলের কৃষ্ণচঞ্চল ঢেউ  থেকে। রক্তাভ তির তির নাকের ডগা থেকে। দু’চোখের সীমাহীন প্রাচুর্য থেকে। মূর্ত  স্তনের বিমূর্ত   স্থাপত্য থেকে। অসীম রহস্যপ্রান্তরে বিলীন হয়ে যাওয়া কটিদেশেরর কলকলে স্রোতস্বিনী থেকে!

নূপুর নাচে। প্রাণভরে নাচে। খালি পায়ে নূপুর ছাড়াই রিনিঝিনি নাচে। এবং রিনিঝিনিটা কোথায় বাজছে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে নূপুর!

নুপূরের মন বলে- এই যে আমি! আমার ভেতরেই রিনিঝিনি বাজে। নাচো নূপুর নাচো!

নূপুর নাচতে থাকে। নিজের ঘরে একা একা নাচতে থাকে নুপুর!

চব্বিশ বছর বয়েসী নূপুরের কি হয়েছে? নূপুর কি মাস্টার্স পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছে? নূপুর কি চাকরিতে বড়সড় ইনক্রিমেন্টসহ প্রোমোশন পেয়েছে? নূপুর কি তার হারানো সোনার নোলক খুঁজে পেয়েছে? নূপুরকে কি পছন্দের কেউ প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে? নূপুর নিজেই কি কারো প্রেমে পড়েছে? 

না, এসবের কিছুই ঘটেনি! 

আজ দুপূর পর্যন্তও যে ব্যাপারটা তার জীবনে ঘটবে বলে নূপুর কোনদিন ভাবেনি, সেটাই ঘটেছে!

একটা মেয়ে যে রূপবতী সেটা সে নিজে যতোটা না জানে, তারচেয়ে বেশি জানিয়ে দেয় আশপাশের পুরুষেরা! রূপবতীদর্শনে বজ্রাহত পুরুষদের  চোখের তারায়, নাকের খাড়ায়, কাঁধের ঝাড়ায়, পায়ের পাড়ায় যে  অভিব্যক্তিগুলো জেগে উঠে সেগুলোই রূপবতীকে বলে দেয়, এই জগতে কতোটা অমূল্য সে। যে অমূল্য অনুভব দিয়ে রূপবতী বিশ্বের তাবৎ পুরুষকে অবজ্ঞা করে, সেই অমূল্য অনুভূতি তার ভেতরে পুরুষই মূলত সৃষ্টি করে দেয়!

বয়োঃসন্ধিকাল পার হবার পর থেকে নূপুর সবসময় একজন মন মানুষ সন্ধান করেছে। সন্ধান করতে গিয়ে সে সফল মানুষ পেয়েছে, সরল মানুষ পেয়েছে, এমনকি বনমানুষও পেয়েছে! কিন্তু মন মানুষ পায়নি!

সফল মানুষ ছিলেন আদনান খান। মোটা চশমা পরা বুয়েটের লেকচারার। নূপুরের সাথে প্রথম ডেইটিং এর প্রথম লেকচারেই স্যার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, মানুষ এবং সফল মানুষের মধ্যে ব্যবধান দুস্তর। নূপুরের বাঁধহীন কূন্তলসমগ্রকে বেনসন এন্ড হেজেজের নীল ধোঁয়ার সাগরে ভাসিয়ে দিতে দিতে স্যার বলেছিলেন,

আজকে আমি একজন সফল মানুষ বলেই তোমাকে পেয়েছি।

চমকে উঠে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল নূপুর। তারপর বলেছিলো, আমি তো সফল কোন মানুষ না। তারমানে আমি কি তোমাকে পাইনি?

তুমি লক্ষ পুরুষের আকাঙখিত নারী। সেই লক্ষপুরুষের আমিও একজন। নিরান্নব্বুই হাজার নয়শ নিরান্নব্বুই জন তোমাকে পায়নি। তাদের চেয়ে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন আমিই তোমাকে  পেয়েছি।  আর তোমার যোগ্যতায় তুমিও আমাকে পেয়েছো। 

আমার যোগ্যতাটা কি?

সেই প্রশ্নটা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে করো! 

আয়নায় তো কেবল শরীর দেখা যায়! চোখ, নাক, চুল, কাঁধ, বুক!

শরীরই ত আমাদের কল্পনার সূখের দূয়ার খুলে দেয়। শরীরকে কিভাবে অস্বীকার করি?

তার মানে তোমার জন্য আমার কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম হলো শুধু শরীর?

মাধ্যম শরীর হলে কি অসুবিধা?

মাধ্যম যখন শুধু শরীর হয় তখন  প্রেমের যাত্রা হয় শুধুমাত্র সঙ্গম পর্যন্ত। সঙ্গম শেষ, প্রেমও শেষ!

কিন্তু এটা ত প্রকৃতির ডিজাইন!

উঁহু! প্রকৃতি চূড়ান্ত  ডিজাইন করেনি!  আমাদের মনের ডিজাইনকেই আমরা প্রকৃতির ডিজাইন বলে ধরে নেই। 

আমার মনের ডিজাইন নিয়ে কি তোমার সমস্যা আছে?

হ্যাঁ আছে। এমন মন মানুষ আমি চাইনা যার আমার কাছে পৌঁছানোর একমাত্র মাধ্যম শরীর!

আমি কি তোমার মন মানুষ হবার যোগ্য না?

না! 

আমি কি তোমাকে পাই নাই?

না!

নাকি তুমিই আমাকে পাও নাই?

তুমি আমাকে তোমার মতো করে পেয়েছো। আমি তোমাকে আমার মতো করে পাই নাই। কাজেই প্রেমের বাত্তি আসলে জ্বলে নাই!

বুঝিয়ে বলো।

প্রেমের বাত্তি তখুনি  জ্বলে যখন প্রেমের সার্কিটে কারেন্ট ফ্লো করে। প্রেমের সার্কিটে কারেন্ট তখুনি ফ্লো করে যখন সার্কিটে থাকা দুজনেই দুজনকে নিজের মত করে পায়!

যদি একজন পায় আর আরেকজন না পায়, তখন কি হয়?

তখন একজন খাম্বার মত দাঁড়িয়ে থাকে। আরেকজন এসে খালি ধাক্কা দেয়। খাম্বা একসময় স্পার্ক করতে থাকে!

তুমি যে ফিজিক্স পাশ এটা আমার খেয়ালই থাকেনা!

খেয়াল থাকবে কেমনে? তোমার আয়নায় ত খালি আমার চোখ, মুখ, বুক দেখা যায়!

নূপুরের শেষ সংলাপে  রেস্তোরাঁর ছোট্ট টেবিলে বিশাল নিরবতা নেমে এসেছিলো। স্যারের মুখের দিকে  গভীরভাবে  তাকিয়ে নূপুর পরিস্কার বুঝতে পেরেছিলো  ডেইটিং এর তারিখ ঠিক হবার পর থেকে স্যারের মুখে যে বিন্দু বিন্দু রোমান্সগুলো জমেছিলো, নূপুরের সর্বশেষ সংলাপ শোনার পর সেগুলো বিন্দু বিন্দু করে খসে যাচ্ছে মুখ থেকে।মাত্র  কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে  একটু আগের উষ্ণ রোমান্টিক প্রাণী থেকে স্যার একটা শীতল অসহায় প্রাণীতে পরিণত হয়েছেন।একটু আগে  যে কফিতে  চুমুক দেবার পর স্যারের মুখ দেখে মনে হয়েছিল এরচেয়ে সুস্বাদু কফি পৃথিবীতে আর নাই,এই মুহূর্তে  সেই একই কফিতে চুমুক দেবার পর স্যারের মুখ দেখে মনে হলো এর চেয়ে বিস্বাদ বস্তু পৃথিবীতেই দ্বিতীয়টা নাই! 

কফির কাপ নিজের থেকে বেশ খানিকটা দূরে সরিয়ে রেখে সিগারেট ধরিয়ে খুব গভীর একটা টান দিলেন স্যার। তারপর নূপুরের চোখে চোখে তাকিয়ে বললেন,

পরিবার-সমাজ-শিক্ষক-বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে যে আয়নাটা শৈশব থেকে ধীরে ধীরে তৈরি করে দিয়েছে, সে আয়না একদিনে ভেঙ্গে ফেলার কোন উপায় নাই!

যে আয়নায় আমাকে খুঁজে পাওয়া যায়না সে আয়নার সামনে সারাজীবন দাঁড়িয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া নিশ্চয় অনুচিত!

রেস্তোরার ছোট্ট টেবিলটা এরপর যেন গোরস্তান হয়ে গিয়েছিলো। ‘প্রেম’কে সেখানেই দাফন করে দুই শ্মশানযাত্রী  ফিরে গিয়েছিল আপন আপন  সারাইখানায়!

মানুষের মনের ভেতরে নিজ নিজ সারাইখানা থাকে।  মন যখন সংঘাতে চুর বিচুর হয় তখন মানুষ সেই সারাইখানায় গিয়ে মনকে যতটুকু পারে ঠিকঠাক করে নেয়!

সফল মানুষ আদনান স্যারের পর নূপুরের জীবনে এসেছিলো এক সরল মানুষ। সরল মানুষ সোহরাব হোসেন ছিল বেসরকারী কোম্পানীর এইচআর ম্যানেজার। এইচআর ম্যানেজার স্যার প্রেম করার আগে রীতিমত চাকুরির ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন নূপুরের!

চাকুরিপ্রার্থীকে যেমন করে জিজ্ঞেস করে, এর আগে কোথায় কোথায় চাকুরি করেছিলেন তেমন করে তিনি নূপুরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এর আগে কার কার সাথে প্রেম করেছো?

নূপুর চাকুরিপ্রার্থীর মতো করেই জবাব দিয়েছিলো, স্যার(!) আমার তো ছয় বছরের প্র‍্যাক্টিকাল অভিজ্ঞতা। চিঠি লেখা, কবিতা লেখা, ঝগড়া করা, এছাড়াও ‘বলতে শরম করে’ এরকম অভিজ্ঞতাও আছে।  আপনার কোন চিন্তা নাই স্যার!

চশমার মোটা কাঁচ চোখ থেকে নামিয়ে রূমাল দিয়ে চোখের পিচুটি মুছতে মুছতে ম্যানেজার সাহেব বলেছিলেন, আমার গতকাল থেকে চোখ উঠছে বুঝছো! এখন বুঝতেছি আমার চোখের মণিতে যতো ভাইরাস তোমার হৃদয়ে তত প্রেম।

আপনার কাছে কি ভ্যাক্সিন টেক্সিন আছে স্যার? থাকলে ভ্যাক্সিন মাইরা দেন। আগের প্রেম ভাইরাস যা আছে সব দূর হইয়া যাক। একদম নতুন সার্ভিসিং করা ইন্টাক্ট হৃদয় নিয়ে আপনার সাথে প্রেম শুরু করি!

সোহরাবের নাকে বিস্কুটের গুঁড়ো লেগেছিল। টিস্যু দিয়ে বিস্কুটের গুঁড়া মুছতে মুছতে বলে সোহরাব,মানুষের হৃদয় সবসময় ইনট্যাক্ট। সে একটা প্রেম করুক আর দশটা প্রেম করুক। 

নূপুরের নাকে বিস্কুটের গুঁড়া লাগে নাই। নুপুর খামোকাই নাকের ডগা চুলকাতে চুলকাতে জিজ্ঞেস করেছিলো, দশটা প্রেম করার পরও মানুষের হৃদয় কিভাবে ইনট্যাক্ট থাকে?

কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থেকে গরু যেভাবে জাবর কাটে সেভাবে মুখ বাঁকাতে বাঁকাতে বলেছিলো সোহরাব, মানুষের হৃদয়ে ময়লা ধরে মনে অহংকার আসলে, প্রেম করলে হৃদয়ে ময়লা ধরেনা!

যদি কেউ একসাথে দশটা প্রেম করে?

একসাথে ত দশটা প্রেম করা যায় না!

কেন? করা যাবেনা কেন?

মানুষের দশটা পুকুর ভালো লাগতে পারে। কিন্তু একসাথে তো দশটা পুকুরে ডুব দেওয়া যায়না।

ধরেন, কেউ আজকে একপুকুরে ডুব দিলো। কালকে আরেক পুকুরে। পরশু আবার আরেক পুকুরে!

আসলেই তো! এভাবে তো চিন্তা করি নাই!

ভাল করে চিন্তা করেন। চাইলে একসাথে দশটা প্রেমও করা যায়!

এখন তো তাই মনে হচ্ছে!

খুশি খুশি লাগতাছে?

বুঝতাছিনা।

আমি বুঝাইয়া দেই?

দেও!

কেউ যদি আসলেই একটা পুকুরের প্রেমে পড়ে তাহলে সেই এক পুকুরেই সে তল খুঁজে পাবেনা। আর যে যেই পুকুরের তল খুঁজে পায়না, তার ত সেই পুকুরেরই প্রেমে পড়া উচিৎ! 

কও কি? একপুকুরেরই যদি তল খুঁজে না পায়, তাহলে ত আজীবন সেই একপুকুরেই হাবুডুবো খাবে!

হ্যাঁ। একপুকুরের রহস্য উদঘাটন করতে করতেই তার জীবন পার হয়ে যাবে!

তারমানে একসাথে দশজনের সাথে প্রেমের তত্ত্ব ভুল।

ভুল। কারণ, এটা আসলে প্রেম নয়। লাম্পট্য!

মানুষ লম্পট হয় কেন?

অযোগ্যতার কারণে। মন এক জায়গায় স্থির রাখতে পারেনা। আজ এখানে, কাল ওখানে মন লাট খায়। লাট খেতে খেতে কিছু আবিস্কার না করেই একসময় ডুবে যায়!

আজীবন এক কলসীর তলা আবিস্কার করার চেষ্টা করলে কি আর্কিমিডিস হয়ে যাবে?

হইতেও পারে। কিন্তু কেউ ত চেষ্টাও করেনা!

আমি চেষ্টা করবো!

সোহরাবের দিকে তাকিয়ে নুপুরের মনে হয়েছিলো সে সত্যি সত্যি চেষ্টা করবে। কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছে  এটা তার তাৎক্ষণিক মতিভ্রম! যার মাথায় একবার দশপুকুরে ডুব দেবার চিন্তা ঢুঁ মেরেছে সে  একপুকুরের তলা খুঁজতে সারাজীবন দিয়ে দেবে, এটা বিশ্বাস করা কষ্ট!

আদনান সোহরাব শূন্য রানে আউট হবার পর দীর্ঘদিন কাউকে ক্রিজেই আসতে দেয়নি নূপুর! তার মনে হয়েছে- তার মনের মাঠে রান করতে পারে, এমন ব্যাটসম্যানই এই পৃথিবীতে জন্মায়নি। কিন্তু একদিন ঘটনা ঘটে গেলো!

হাফ সেঞ্চুরি করলেই সবাই হাফবুড়ো হয়না। বরং হাফসেঞ্চুরির পরেই অনেক পুরুষের লেজে রঙিন পালক গজাতে দেখা যায়! কালিগঞ্জের কামরুলের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়েছিলো এবং তার পাকাগোঁফের নীচের মুচকি হাসিতে ঝরা লাস্যকে মুক্তো বলে ভ্রম করেছিলো নূপুর! ফলাফল হিসেবে ঢাকা টু খুলনা ডাবল ডেকার বাসের আপার ডেকের ফ্রন্টসীটে কামরুলের সহযাত্রী হয়েছিলো নূপুর এবং মানিকনগর থেকে ভাটিয়াপাড়া পর্যন্ত তিন ঘন্টার যাত্রাপথে লুচোরোমান্টিকতার যে মহাকাব্য হাই অফিশিয়াল কামরুল রচনা করেছিলেন তা নিম্নরূপ-

প্রথমধাপে মাওয়া এক্সপ্রেস হাইওয়েতে কামরূলের লুচোরোমান্টিকতার নির্মম আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন আর কেউ নন, উপমহাদেশ তথা সারাপৃথিবীর কিংবদন্তি সঙ্গীত সম্রাট মান্না দে! দূমুখো ইয়ারফোনের একমুখ নিজের কর্ণকুহরে, আরেকমুখ নূপুরের কর্ণকূহরে প্রবেশ করিয়ে মান্না দের সাথে নিজেও আচমকা গেয়ে উঠেছিল- দোয়াই লাগে, সুন্দরী গো, মান করোনা!

গান গাইতে গিয়ে কামরুল যখন গো কে গু উচ্চারণ করেছিলো তখুনি গা গুলিয়ে উঠেছিলো নূপুরের, আর গু বলার পর পর যখন টকাস করে নূপুরের কানের লতির নীচে চুমু খেয়েছিলো তখন নূপুরের মনে হয়েছিলো, পদ্মা ব্রীজ আসলেই সে পদ্মানদীতে ঝাঁপ দিয়ে পড়বে এবং সাঁতরে ভাঙ্গা অর্থাৎ ডাঙ্গায় উঠে যেদিকে দূচোখ যায় চলে যাবে!

নূপুরের ভাগ্য ভালো পদ্মা ব্রীজের উপর উঠার পর কামরুলের নির্দয় আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন আরেক কিংবদন্তী সঙ্গীতবিস্ময় আব্দুল আলীম। তবে এই গানে ‘ সুন্দরী গো’ টাইপের কোন বাক্য না থাকায় কামরুলের অশ্লীল চুম্বন থেকে নূপুর  বেঁচে গিয়েছিলো!

ভাটিয়াপাড়া এসে গাড়ি যখন মোড় ঘুরছিল তখন কামরুল হঠাৎ করেই ভজন গাইতে শুরু করেছিলো এবং এবার সে সাক্ষাৎ যমদূত হয়ে উপমহাদেশের আরেক জীবন্ত কিংবদন্তি অনূপ জালোটার টুঁটি টিপে ধরেছিল। ভজন গাইতে গাইতে আচমকা পার্শ্বোপবিষ্ট উর্বশীর কোমর জড়িয়ে ধরেছিলো কামরুল এবং বুকে থু থু দিতে দিতে নূপুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সে পুরো খুলনা শহর পর্যন্ত কামরুলের সাথে না গিয়ে সাননেই ফকিরহাট নেমে যাবে। ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা ফকিরহাটে নূপুরের নানার বাড়ি!

আদনান-সোহরাব-কামরুল এই তিনপুরুষ পাড়ি দেবার পর নূপুর নিজের হৃদয়ের খুব গভীরে নিঃশব্দ একটা  কান্না আবিস্কার করেছিলো কারণ তার মনে হয়েছিলো সে একজন দূর্ভাগা মানুষ বলেই এ জীবনে তার সফল মানুষ দেখা হয়েছে, সরল মানুষ দেখা হয়েছে, এমনকি অন্যপ্রান্তের অনূভূতির কিছুমাত্র তোয়ক্কা না করা কামরুল নামক বনমানুষও দেখা হয়েছে, কিন্তু মন মানুষের দেখা আর পাওয়া হয়নি!

কিন্তু মানুষের মন অদ্ভুৎ! সে মানুষের সাথে কখন কী খেলা খেলে, বোঝা দায়!

আজ দুপূরবেলা নূপুর বাসায় একা ছিলো। তার প্রচণ্ড ক্ষিধে ছিলো কিন্তু রান্না করতে ইচ্ছা করছিলো না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে যখন কী করা যায় ভাবতেছিলো, তখুনি হঠাৎ করে তার মাথায় অদ্ভুৎ চিন্তাটি এসেছিলো। মনমানুষ এর চরিত্র সে যেরকমটা ভাবে, সেরকমটা সে নিজে হতে পারবে কীনা!

একেকটা পুরুষ চরিত্রকে মনে মনে চোখের সামনে আয়না হিসেবে দাঁড়া করিয়েছিলো নূপুর। তারপর তার ভেতর দিয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছিলো নিজেকে। 

প্রথমেই এসেছিলেন আদনান খান!

আদনান খান একজন সফল শিক্ষিত পুরুষ। চিন্তাভাবনায় সৎ। ‘নারীর সাফল্যকে রূপ দিয়ে বিচার করা’র স্তর থেকে উপরে উঠতে না পারার কারণে সে নূপুরের মন মানুষ হতে পারেনি।  

পুরুষ নারীর রূপ দেখে আকৃষ্ট হবে এবং পুরুষের মন নারীর রূপ দিয়ে তাকে বিচার করবে, এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু কোন পুরুষ যদি আরেকটু গভীরে গিয়ে নারীকে আবিস্কার করার চেষ্টা করতো তাহলে শরীর ছাড়াও নারীর অন্যান্য নিজস্ব অর্জনগুলো তার সৌন্দর্যবোধের সাথে যুক্ত হতো। আদনান চিন্তার গভীরে গিয়ে বুয়েটে ফার্স্ট হবার উপায় আবিস্কার করেছে, রাতের গভীরে কল্পনারীর রূপ সায়রে ডুবও দিয়েছে নিশ্চয়, কিন্তু নারীকে আবিস্কার করার চেষ্টা করেনি। এজন্য তার নারীভাবনা শুধুমাত্র দেহের রূপের মধ্যেই আটকে গেছে!

আদনান নামক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এবার নিজেকে প্রশ্ন করে, নূপুর তুমি নিজে কি কখনো চেষ্টা করেছো কোন পুরুষের গভীরে গিয়ে তাকে আবিস্কার করতে? পুরুষের যেসমস্ত গুন এবং রূপ  দিয়ে তুমি তাকে বিচার করো, তার ভেতরে আরো গভীর আরো সুন্দর কিছু বিকশিত হয়ে আছে কীনা তার অনুসন্ধান কি তুমি কখনো করেছো? 

নারীকে শুধু দেহের রূপ দিয়ে বিচার করে পুরুষ যে ভুল করেছে, নারীও কি প্রকারান্তরে একই ভূল করেনি তাকে শুধুমাত্র কিছু কথিত সাফল্য দিয়ে বিচার করে? 

নারী নিজেই পুরুষের সাফল্যের মাপকাঠি ঠিক করে দিয়েছে। সেই মাপকাঠি অনুযায়ী পুরুষ নিজেকে গড়ে নেবার পরে নারীই আবার সেই পুরুষের মধ্যে অপূর্ণতা আবিস্কার করেছে! বলেছে- তোমার সাফল্য আছে, কিন্তু রোমান্টিকতা নাই, সংবেদনশীলতা নাই! 

ঠিক একই কাজ করেছে পুরুষ। পুরুষ নারীকে আজীবন বলেছে- তুমি নারী হও। তুমি রূপে নারী হও। তুমি গুনে নারী হও। তুমি চালচলনে নারী হও। তুমি আদবকায়দায় নারী হও। চলনে- বলনে-ফ্যাশনে, তুমি কেবল নারীই হও। 

পুরুষের সংজ্ঞা অনুযায়ী নারী নিজেকে গড়ে নেবার পর পুরুষই আবার সেই নারীর মধ্যে অপূর্ণতা আবিস্কার করেছে। বলেছে- তোমার মধ্যে নারীত্ব আছে, কিন্তু সর্বাঙ্গীন মনুষ্যত্ব নাই! 

পুরুষ এবং নারী উভয়েই নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী একে অপরকে গড়তে গিয়ে কেউ কাউকে সর্বাঙ্গীন মানুষ হিসেবে বিকশিত হতে দেয়নি। নারী যেমন পুরুষকে পুরুষ বানাতে গিয়ে বামনে পরিণত করেছে, পুরুষও তেমন নারীকে নারী বানাতে গিয়ে বামনে পরিণত করেছে। এবং সেই ‘বামন মানুষ’দের কেউ আদনান হয়েছে, কেউ সোহরাব হয়েছে, কেউবা কামরুল হয়েছে, কিন্তু মন মানুষ কেউ হয়নি! নূপুর নিজেও নিশ্চয় মন মানুষ হতে পারেনি। কোন পুরুষ যদি তার জীবনে আসে, রূপসায়রে ডুব দিয়ে কিছুদিন বেহূঁশ থাকবে ঠিক। তারপরেই আবিস্কার করবে- নূপুর সর্বাঙ্গীন কোন মানুষ নয়, মন মানুষ নয়!

আদনানের পর সোহরাব এবং কামরুলও নূপুরের মানসকল্পনায় তার সামনে এসে আয়না হয়ে দাঁড়িয়েছিলো! তাদের মুখের চেহারায় এক অদ্ভুৎ অসহায় হাসি নূপুর দেখতে পেয়েছিলো যেটা আসলে তার নিজের মনের ভাবনাকেই প্রতিফলিত করেছিলো। নূপুরের মনে হয়েছিলো- এই মানুষগুলোর ভেতরেও নানান রকম অনাবিস্কৃত সৌন্দর্য থাকা সম্ভব। যে সৌন্দর্য আমরাই ঢেকে রাখতে উৎসাহ দেই, ঢেকে রাখার কারণে তার উপরে জন্মানো উৎকট আগাছা দেখে আমাদেরই গা গুলিয়ে উঠে। তারপর আমরাই তাকে আবর্জনা বলে ঘোষণা দেই!

অনেক অনেক দিন পরে একটা সিগারেট ধরায় নূপুর! বেনসন এন্ড হেজেজ। অনেক অনেকদিন পরে পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী নূপুরের নিজেকে মনে হয় আইনস্টাইন!

সিগারেটে সুগভীর দম দিয়ে নূপুরাস্টাইনের মনে হয়- বেনসন এন্ড হেজেজ!  দুজনেই একে অপরকে নিজ নিজ স্বার্থমত গড়তে গিয়ে দূজনেই দুজনকে স্রেফ অর্থকরী পন্যে পরিণত করে ফেলেছে নিজের অজান্তেই! তারপর বেনসন হেজেজের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে আবিস্কার করেছে- হেজেজ তার মন মানুষ নয়! হেজেজও বেনসনের দিকে তাকিয়ে আবিস্কার করেছে- বেনসন তার মন মানুষ নয়!

আবিস্কারের উত্তেজনায় নূপুর কাঁপতে থাকে। তারপর  কল্পনার ব্ল্যাকবোর্ডে চকখড়ি দিয়ে লিখে- নারী এবং পুরুষ গড়ার কারখানায় নারী বা পুরুষরূপী মালই উৎপাদন করা সম্ভব। মানুষ তথা মন মানুষ উৎপাদন করা সম্ভব না!

সূত্র লেখার পর নূপুরের মন মুকুরে ময়ূর নাচে! নূপুরের নাচতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে বাস্তবায়নের জন্য নুপুর ঘরের বড়সড় আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়ায়!

কথা সাহিত্যিক এবং নাট্যকার মহিউদ্দিন খালেদ পেশাগত জীবনে একজন যন্ত্রপ্রকৌশলী এবং বর্তমানে জি-গ্যাস এলপিজিতে অপারেশন বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন। 

MD IMRAN HOSSAIN
MD IMRAN HOSSAINhttps://themetropolisnews.com/
Md. Imran Hossain, a certified SEO Fundamental, Google Analytics, and Google Ads Specialist from Bangladesh, has over five years of experience in WordPress website design, SEO, social media marketing, content creation, and YouTube SEO, with a YouTube channel with 20K subscribers.

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

3,800FansLike
300FollowersFollow
250SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles