এ বছরের রসায়নে নোবেল পুরস্কার অন্যরকম তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, বিজয়ীদের মধ্যে অন্যতম কার্ল ব্যারি শার্পলেস ইতিহাসের মাত্র পঞ্চম ব্যক্তি হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো এই পুরস্কার জিতেছেন। আবার আরেক বিজয়ী ক্যারোলিন রুথ বার্তোজি ইতিহাসের মাত্র অষ্টম নারী হিসেবে রসায়নে এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার অর্জন করেছেন। এই দুইজন বিজ্ঞানীর সাথে এবারের পুরস্কারটি সমপরিমাণে ভাগ করে নিয়েছেন ড্যানিশ রসায়নবিদ এবং কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক মর্টেন পিটার মেলডাল।
এই বছরের নোবেল পুরস্কারের মূল বিষয়বস্তুর জনক কার্ল ব্যারি শার্পলেস একজন আমেরিকান রসায়নবিদ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ক্রিপস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রসায়নের অধ্যাপক। তিনি ২০০০ সালের দিকে “ক্লিক রসায়ন” নামে রসায়নের একটি নতুন শাখা আবিষ্কার করেন। তিনি চাইতেন রসায়নবিদরা যেন প্রকৃতি থেকে বিভিন্ন যৌগের নকল বা প্রতিরূপ তৈরি না করে; কারণ, অত্যন্ত জটিল আণবিক কাঠামোর এসব যৌগ নতুন ঔষধের আবিষ্কারের ক্ষেত্রে প্রায়শই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ক্লিনিকাল ট্রায়ালের জন্য স্বল্প পরিমাণে এই ধরণের প্রাকৃতিক যৌগ তৈরি করা তেমন কঠিন না হলেও ব্যাপক শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে উচ্চ উৎপাদন দক্ষতা অর্জন করা অনেক সময় ভীষণ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, ব্রড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক মেরোপেনেম শিল্পোৎপাদনের পর্যায়ে যেতে বিজ্ঞানীদের ৬ বছরেরও বেশি সময় লেগেছে।
এখন “ক্লিক রসায়ন” কি তা জেনে নেয়া যাক। ধরুন আপনার স্ক্রু ড্রাইভারটি কোন একটি স্ক্রুর মাথার সাথে ঠিকভাবে লাগছে না। বার বার পিছলে যাওয়ার কারণে স্ক্রু লাগানোর মত সহজ কাজটি ভীষণ সময়সাপেক্ষ এবং ক্লান্তিকর হয়ে উঠেছে। অথচ, যদি আপনার স্ক্রু ড্রাইভারের মাথাটি চুম্বকায়িত করে নেয়া যেত, তাহলে স্ক্রু কিন্তু একদম স্বয়ংক্রিয়ভাবে “ক্লিক” করে সঠিক জায়গাতেই আটকে যেত! “ক্লিক রসায়ন”-ও ঠিক এইভাবেই কাজ করে। বিজ্ঞানীরা তাদের নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন জৈব-অণু সংশ্লেষণের জন্য এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সফল হয়েছেন।
নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে কিছু নির্দিষ্ট রাসায়নিক পদার্থকে পরস্পরের সাথে বিক্রিয়া করিয়ে অবাঞ্ছিত উপজাতগুলিকে নির্মূল করার মাধ্যমে নির্দিষ্ট পছন্দসই যৌগ তৈরির প্রক্রিয়াই হল “ক্লিক রসায়ন”। এর মাধ্যমে সামগ্রিক উৎপাদন দক্ষতা প্রায় শতভাগেও পৌঁছাতে পারে। এটি যদি কখনো প্রকৃতিতে প্রাপ্ত অণুর নিখুঁত প্রতিরূপ তৈরি করতে সক্ষম নাও হয়, প্রায় অনুরূপ কার্যকারিতা সম্পন্ন অণু কিন্তু ঠিকই তৈরি করে নিতে পারে। বিভিন্ন ধরণের রাসায়নিক উপাদান মিলিয়ে এটি অসংখ্য যৌগ প্রয়োজনমত তৈরি করে নিতে পারে, যা একই সাথে প্রাকৃতিক ঔষধের মত কার্যকরী এবং শিল্পোৎপাদনের পর্যায়ে যাওয়ার উপযোগী।
নিজ দাবির প্রতি সমর্থনস্বরুপ বেশ কিছু বিদ্যমান রাসায়নিক বিক্রিয়ার উদাহরণ প্রদানের পাশাপাশি ডঃ শার্পলেস ২০০১ সালে ক্লিক বিক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য কিছু পূর্বশর্ত প্রকাশ করেছিলেন। যেমনঃ
ক) ক্লিক বিক্রিয়া এক পাত্রে ঘটে।
খ) ক্লিক বিক্রিয়া পরিবেশে বিদ্যমান পানি বা অন্য কোন পার্শ্ববর্তী পদার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয় না।
গ) ক্লিক বিক্রিয়াগুলি খুবই অল্প পরিমাণে অবাঞ্ছিত উপজাত উৎপন্ন করে।
ঘ) ক্লিক বিক্রিয়াগুলি উচ্চ তাপগতীয় শক্তির প্রভাবে অত্যন্ত দ্রুত ঘটে থাকে।
ঙ) ক্লিক বিক্রিয়াগুলি একমুখী এবং প্রয়োজনীয় উৎপাদ প্রায় শতভাগ সফলতার সাথে উৎপন্ন করে।
“কপার-ক্যাটালাইজড অ্যাজাইড-অ্যালকাইন সাইক্লোঅ্যাডিশান”, বর্তমানে যা “ক্লিক রসায়ন”-এর প্রায় সমার্থক – এই সময় পর্যন্তও সবার কাছে অজানাই ছিল।
মোটামুটি একই সময়ে রসায়নবিদ ডঃ মর্টেন মেলডালও কোপেনহেগেনে তার গবেষণাগারে একই বিষয় নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করছিলেন এবং সম্ভাব্য ফার্মাকোলজিক্যাল যৌগ সনাক্ত করার কৌশল নির্ণয়ের চেষ্টা করছিলেন। তিনি তার সংগ্রহে থাকা বিশাল সংখ্যক অনন্য যৌগসমূহ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতেন এর মধ্যে কোনোটি প্যাথোজেনিক বা রোগ সৃষ্টি হওয়ার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে কিনা।
একদিন ক্যাটালিস্ট বা অনুঘটক হিসাবে কিছু কপার আয়ন আর এক চিমটি প্যালাডিয়ামের উপস্থিতিতে অ্যালকাইন এবং অ্যালকাইল হ্যালাইডের সাথে বিক্রিয়া করার সময় ডঃ মেলডাল এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেন – অ্যালকাইন অণু অ্যালকাইল হ্যালাইড অণুর ভুল প্রান্তের সাথে বিক্রিয়া করায় অন্য প্রান্তে অ্যাজাইড তৈরি হয়ে যায়। এই অ্যাজাইড এবং অ্যালকাইন আবার একসাথে মিলিত হয়ে ট্রায়াজোল তৈরি করে ফেলে, যা অত্যন্ত স্থিতিশীল এবং সাধারণত বিভিন্ন ঔষধ, রং বা কৃষি যৌগে পাওয়া যায়। এর আগে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে এই ধরণের বিক্রিয়ায় অনেক অবাঞ্ছিত উপজাত তৈরি হয়, কিন্তু তামার আয়নগুলির উপস্থিতি স্রেফ যাদুর মত কাজ করে – শুধুমাত্র কাঙ্ক্ষিত ট্রায়াজোলই তৈরি হয়। ডঃ মেলডাল ২০০১ সালে একটি সিম্পোজিয়ামে এবং ২০০২ সালে একটি জার্নালে তার এই অসামান্য কাজের ফলাফল প্রকাশ করেন। তিনি দেখিয়েছিলেন যে এই প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু স্বতন্ত্র অণুকে একসাথে যুক্ত করা যেতে পারে।
ঠিক এই বছরেই ব্যারি শার্পলেসও তার নিজের মত করে কাজ এগিয়ে নিয়ে কপার অনুঘটকের উপস্থিতিতে সাফল্যের সাথে অ্যাজাইড আর অ্যালকাইনের মধ্যে বিক্রিয়া সম্পন্ন করে উক্ত ফলাফল নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন-যাতে দেখান হয় যে, এই বিক্রিয়াটি পানির উপস্থিতিতেও ঘটতে পারে। তিনি এটিকে একটি “নিখুঁত ক্লিক বিক্রিয়া” বলে অভিহিত করেন।
সহজে ব্যবহারযোগ্য হওয়ার কারণে শিল্পোন্নয়ন কিংবা পরীক্ষাগারের গবেষণা, উভয় ক্ষেত্রেই ক্লিক বিক্রিয়া বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এমন পদার্থেও ক্লিক করা সম্ভব হয়েছে যা বিদ্যুৎ সঞ্চালন করতে পারে, সূর্যালোক ধরতে পারে, ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী, অতিবেগুনী রশ্মির বিকিরণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে, আবার চাহিদামত অন্য যেকোন কাজও করতে পারে। বর্তমানে ঔষধশিল্পে সম্ভাবনাময় ঔষধ হয়ে উঠতে পারে এমন যৌগ তৈরি এবং ইতোমধ্যে বিদ্যমান ঔষধগুলিকে আরো উন্নত করার গবেষণায় এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে । যাইহোক, ব্যারি শার্পলেস বা মর্টেন মেলডালের মধ্যে কেউই কিন্তু এমন কোন পূর্বাভাস দেননি যে এটি জীবিত প্রাণীর দেহেও প্রয়োগ করা যেতে পারে। ২০২২ সালের রসায়নে নোবেল পুরস্কারের বাকি অংশ মূলত এই পূর্বাভাস না দেয়া কাজ নিয়েই।
আমেরিকান রসায়নবিদ এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সায়েন্সেসের অধ্যাপক ডঃ ক্যারোলিন বার্তোজি “ক্লিক রসায়ন”কে একটি সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা দান করেন। তিনি প্রাণী কোষপৃষ্ঠে পাওয়া গ্লাইকান নামক গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিনের গতিপ্রকৃতি বুঝার জন্য প্রানীদেহে ব্যবহার উপযোগী ক্লিক বিক্রিয়া সৃষ্টি করেন। তার এই বায়োঅর্থোগোনাল প্রক্রিয়াগুলি কোষের নিয়মিত রসায়নে হস্তক্ষেপ না করেই ঘটানো যায়।
ক্যান্সার, প্রদাহ এবং কোভিড-১৯-এর মতো ভাইরাল সংক্রমণের গতি-প্রকৃতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ডঃ বার্টোজির এই প্রচেষ্টা এখন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। তিনি এই ধরণের রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য “বায়োঅর্থোগোনাল রসায়ন” নামে বিজ্ঞানের একটা ধারার জন্ম দেন যেখানে বিক্রিয়াগুলো জৈব অণুদের কোনভাবে প্রভাবিত না করে কিংবা জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলিতে হস্তক্ষেপ না করে নিশ্চিন্তে জৈবিক পরিবেশে ঘটতে পারে। এটি প্রাণীদেহের জৈবিক প্রক্রিয়ার রহস্য উদঘাটনে বেশ কাজে লাগে। প্রাণীদেহের জন্য কপারের মত বিষাক্ত অনুঘটক ব্যবহার না করার কারণে একে “কপার-মুক্ত ক্লিক রসায়ন”ও বলা হয়।
ক্যারোলিন বার্টোজি ২০০৪ সালে “স্ট্রেন-প্রমোটেড অ্যালকাইন-অ্যাজাইড সাইক্লোঅ্যাডিশানস” (এসপিএএসি) নামে পরিচিত তার এই বিশেষ কাজটি প্রকাশ করেন। এরপর থেকে তিনি তার ক্লিক বিক্রিয়াকে ক্রমাগত পরিমার্জন করে গেছেন যেন এটি প্রাণী কোষে আরও ভালভাবে কাজ করতে পারে। তিনি গবেষণা করে দেখেছেন যে কিছু কিছু গ্লাইকান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা থেকে প্রতিনিয়ত টিউমারকে রক্ষা করতে থাকে। এর ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধী কোষগুলিই অনেক সময় তাদের কার্যক্ষমতা বন্ধ করে দিতে পারে। বার্টোজি তার গবেষণা দলের সাথে মিলে এই প্রক্রিয়াটিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য জৈবিক ফার্মাসিউটিক্যালসের একটি নতুন শাখা তৈরি করেন। তারা টিউমার কোষপৃষ্ঠের গ্লাইকানগুলিকে ভেঙে ফেলার জন্য এনজাইমের সাথে একটি গ্লাইকান-নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি মিলিয়ে নেন। এই ধরণের ঔষধ দিয়েই বর্তমানে শেষ পর্যায়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের উপর ক্লিনিকাল ট্রায়াল করা হচ্ছে।
বর্তমানে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের টিউমারকে লক্ষ্য করে ক্লিকযোগ্য অ্যান্টিবডি তৈরি করছেন। এই ধরণের অ্যান্টিবডি একবার টিউমারের সাথে যুক্ত হয়ে গেলে আরেকটি ক্লিকযোগ্য অ্যান্টিবডি টিউমারে প্রবেশ করানো হয়। উদাহরণস্বরূপ, রেডিওআইসোটোপ দিয়ে ক্যান্সার কোষে রেডিওথেরাপির তীব্র ডোজ সরবরাহ করতে বা পি.ই.টি. স্ক্যানার ব্যবহার করে টিউমার নির্ণয় করতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। যদিও এখনও এটা নিশ্চিতভাবে বলার মত সময় আসেনি-এই ধরণের চিকিৎসা আদৌ সফল হবে কিনা; কিন্তু, এটা নিশ্চিতভাবে বলাই যায় “ক্লিক রসায়ন” এবং “বায়োঅর্থোগোনাল রসায়ন” নিয়ে গবেষণা আরও বহুদূর পথ পাড়ি দেবে এবং মানবজাতির কল্যাণে বেশ ভালভাবে কাজে আসবে।
আরিফ হক বাংলাদেশ বিজ্ঞান পরিষদ এর সভাপতি এবং একজন শিক্ষাকর্মী।
বেশ সাবলীল লেখা। বায়োআর্থগোনাল রসায়ন নিয়ে আরো বিস্তারিত লেখা চাই।