‘কাজীদাকে সালাম’
মহিউদ্দিন খালেদ –
“সোহানা চাকুরি ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ নিশ্চয় গুরুতর। কৌতুহল আটকাতে না পেরে মাসুদ রানা জিজ্ঞেস করেই ফেললো, চাকরি কেন ছেড়ে দেবে?
সোহানা রাগী রাগী গলায় জবাব দিল, আজকে সকালবেলা বুড়োটা আমাকে বকা দিয়েছে!
মাসুদ রানা হা হা হা হা অট্টহাসি হাসছে। মেজর জেনারেল রাহাত খান বকা দিয়েছে, এই জন্য কি কেউ কখনো চাকরি ছেড়ে দেয়!”
“ক্যাপ্টেন উলফ লারসেনের সাথে জুয়া খেলে জাহাজের কুক টমাস মাগ্রিজ। জুয়া খেলে নিজের কাছে যত ডলার ছিল সব খুইয়ে ফেলে ক্যাপ্টেনের কাছে। টাকার অংক দেখে বিস্মিত হামফ্রে বুঝে, টাকাটা আসলে কিছুদিন আগে তার পকেট থেকে চুরি যাওয়া টাকা! হামফ্রে ভ্যান ওয়েডেন ক্যাপ্টেনের উদ্যেশ্যে বলে, টাকাটা আমার।
লারসেন হাসতে হাসতে বলে- হামপ! বলো টাকাটা আমার ছিলো!
বদমাশ বাবুর্চিটা আমার পকেট থেকে টাকা চুরি করেছিল।
তুমি চাইলেও টাকাটা এখন আর আমার থেকে নিতে পারবেনা। কারণ তুমি দুর্বল। দুর্বল হওয়া পাপ!”
“বাবা আমি বব হেলারকে ভালোবাসি। তাকে বিয়ে করতে চাই।
ও ত একজন আউট ল। আউট লদের ভালোবাসতে নেই। গুলি খেয়ে কখন কোথায় মরে পড়ে থাকবে!
বাবা!
বল!
বাবা, মা কিন্তু একজন আউট লকে ভালোবেসেছিল!”
“হোজ্জা নাসিরুদ্দিন আড়াই তোলা হিরের বিনিময়ে একজন গৃহস্বামীকে তার প্রাপ্য হ্রদ এবং জমি বুঝিয়ে দিচ্ছেন। হিরে হচ্ছে একটি চড়ুই পাখি যার ওজন আড়াই তোলা!”
ন্যূনতম তেত্রিশ বছর আগে তৈরি হওয়া এরকম অনেক টুকরো টুকরো দৃশ্য মাথায় আজো গেঁথে আছে। ব্রেনটিউব চালু করে যখন ইচ্ছা তখন এই দৃশ্যগুলো দেখা যায় এবং হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। আমাদের প্রজন্ম, তারও আগের প্রজন্ম এবং তার পরের প্রজন্মের কাছে এইসব সেবা প্রকাশনীর অবদান। আরো পরিস্কার ভাষায় বললে কাজী আনোয়ার হোসেনের অবদান। কাজী আনোয়ার হোসেন অতি স্বল্প পয়সার বিনিময়ে আমাদের মাথায় ক্যাপ্টেন ফিলিয়াস ফগ আর পাসেপার্তো এলান কোয়াটারমেইন আর স্টেলা দিয়েছেন, কুয়াসিমুদু দিয়েছেন, ইন্দাবা জিম্বি দিয়েছেন, ল্যাম্পনি আর রডরিক দিয়েছেন, ওয়াইল্ড বিল হিকক দিয়েছেন, বরাত খান আর গিল্টি মিয়া দিয়েছেন, আরজু বিবি আর কামিল বেগ দিয়েছেন, স্টেলা দিয়েছেন! ব্রেন টিউব চালু করে চাইলেই আমরা এই চরিত্রগুলোর কর্মকান্ড অনুভব করতে পারি। তাদের রক্তমাংসের চেহারার অভিব্যক্তি দেখে রোমাঞ্চিত, শিহরিত, আপ্লুত, বিস্মিত কিংবা ব্যাকুল হতে পারি। আমাদের প্রজন্ম, তারও আগের প্রজন্ম এবং তার পরের প্রজন্মের কাছে এইসব সেবা প্রকাশনীর অবদান। আরো পরিস্কার ভাষায় বললে কাজী আনোয়ার হোসেনের অবদান।
আমি বিস্মিত হয়ে ভাবি, আমার আজকের যে জীবন তাতে কাজী আনোয়ার হোসেন বা সেবা প্রকাশনীর কি অবদান?
পেশাগতভাবে আমি ইঞ্জিনিয়ার। আমি যে কাজ করি সেই কাজ করার জন্য কাজী আনোয়ার হোসেন বা সেবাপ্রকাশনীর নাম না জানলেও চলে। আমার চিনি, আমার চাল, আমার নূন, আমার এন্টাসিড সিরাপ কোনকিছুই কাজী আনোয়ার হোসেন বা সেবা প্রকাশনীর অবদান না। আমার প্রাক-কৈশোর, কৈশোর এবং যৌবনে কাজী আনোয়ার হোসেন বা সেবা প্রকাশনী আদৌ উপস্থিত না থাকলেও সেখানে অন্যকিছু উপস্থিত থাকতো। কাজী আনোয়ার হোসেন বা সেবা প্রকাশনীর অনুপস্থিতিতে আমার প্রাক-কৈশোর, কৈশোর এবং যৌবন অসুন্দর হয়ে যেতো তা আমি মনে করিনা। কিন্তু?
কিন্তু আমি একদম নির্দ্বিধায় পরিস্কার আওয়াজে ঘোষণা দিতে পারি, কাজী আনোয়ার হোসেন বা সেবা প্রকাশনীর উপস্থিতিতে আমার প্রাক-কৈশোর, কৈশোর এবং যৌবন সুন্দর হয়ে গেছে। কাজী আনোয়ার হোসেন বা সেবা প্রকাশনী আমার মস্তিষ্কে যে অনন্য স্মৃতি সঞ্চয় করে দিয়েছে স্থায়ীভাবে, সেটা নিয়ে আমি তৃপ্ত!
কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করার জন্য উপরে উল্লেখিত প্রাপ্তিটুকুই যথেষ্ঠ। তারপরেও মনে হয়, আমাদের জীবনে কাজী আনোয়ার হোসেন বা সেবা প্রকাশনীর অবদান এর চাইতে বেশি। কীভাবে সেটা ব্যাখ্যা করা যাক!
জীবন শেষপর্যন্ত একটা সার্বক্ষণিক লড়াই ছাড়া আর কিছুই না। প্রত্যেককে যার যার অবস্থান, শক্তিমত্তা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। এই লড়াই চালিয়ে যাবার শক্তিটা আসে মূলত মনের কিছু শক্তিশালী সিদ্ধান্ত থেকে। আর মনের সেই সিদ্ধান্তগুলো প্রভাবিত হয় মস্তিষ্কের শক্তিশালী স্মৃতি দ্বারা। আপনার মস্তিষ্কে তৈরি হওয়া স্মৃতির উৎস আপনার বাস্তব অভিজ্ঞতা হতে পারে, আপনার পড়া গল্পের বই হতে পারে, আপনার দেখা সিনেমা হতে পারে, কারো মুখে শোনা গল্প হতে পারে। যে শব্দ-তরঙ্গ বা দৃশ্য-তরঙ্গ আপনার মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করবে, সেটাকেই আপনার মস্তিষ্ক স্মৃতি হিসেবে সঞ্চয় করবে। একবার স্মৃতি সঞ্চিত হয়ে যাবার পর সেটার উৎস নিয়ে মস্তিষ্ক আর চিন্তা করেনা এবং এই চিন্তা না করার ফলাফল আমরা হাতেনাতে পাই!
ধরা যাক আপনার মস্তিষ্কে স্মৃতি সঞ্চিত হয়ে আছে, বাস্তব জীবনে আপনি খুব কঠিন শৈশব কৈশোর পার করেছেন। জীবনের সাথে রীতিমত লড়াই করে, কঠিন যুদ্ধ করে আপনাকে টিকে থাকতে হয়েছে। বড় হয়েও যদি আপনি খুব কঠিন কোন সমস্যায় পড়েন তাহলে শৈশব কৈশোরের সেই জীবনযুদ্ধে জয়ের স্মৃতি আপনার মনের সিদ্ধান্তকে শক্তিশালী করে দেবে। হারার আগেই আপনি হেরে যাবেননা।
আবার ধরা যাক, বাস্তব জীবনে আপনি খুব স্বচ্ছন্দ শৈশব কৈশোর পার করেছেন। কিন্তু আপনি খুব নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে চিল্ড্রেন অভ দ্য নিউ ফরেস্ট বা ডেভিড কপারফিল্ড পাঠ করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, এক্ষেত্রেও আপনি যদি বড় হয়ে কোন কঠিন সমস্যায় পড়েন তাহলে শৈশব কৈশোরে চিল্ড্রেন অভ দ্য নিউ ফরেস্ট বা ডেভিড কপারফিল্ড পড়ার স্মৃতি আপনার মনের সিদ্ধান্তকে শক্তিশালী করে দেবে। হারার আগেই আপনি হেরে যাবেন না!
কাজী আনোয়ার হোসেন তথা সেবা প্রকাশনীর সাথে নিবিড়ভাবে কেটেছে যাদের প্রাক- কৈশোর, কৈশোর বা যৌবন, তারা এই বাড়তি সাপোর্টটুকুও বাকী জীবনে পায়!
জীবনযুদ্ধের ক্লান্তি, আশংকা, ভয় যখন তাদের পর্যুদস্ত করে ফেলতে চায় তখন সেবাপ্রকাশনীর মারফতে পাওয়া স্মৃতিতে থাকা চরিত্রগুলোই উদ্ধারকর্তা হিসেবে এসে তাদের মনের সিদ্ধান্তগুলোকে অসীম শক্তিশালী করে দেয়। এই চরিত্রগুলো কখনো মাসুদ রানা, কখনো সোহানা, কখনো রেবেকা, কখনো মেজর জেনারেল রাহাত খান, কখনো ভিটো কর্লিয়ন, কখনো ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস, কখনো জিম করবেট, কখনো প্রোফেসর চ্যালেঞ্জার, কখনো বার্ট চাচা, কখনো হাকল বেরি ফিন, কখনো বা হোজ্জা নাসিরুদ্দিন! এই চরিত্রগুলোর প্রভাবে প্রভাবান্বিতরা বেশিরভাগ পড়ে যাওয়া মানুষের খুব অল্প যে ক’জন উঠে দাঁড়াতে পারে, তাদের দলভুক্ত হয়ে যায়!
একজন ব্যাক্তি এবং প্রতিষ্ঠান এর কাছে আমাদের এর চেয়ে বেশি আর কি চাওয়ার থাকতে পারে?
কথা সাহিত্যিক এবং নাট্যকার মহিউদ্দিন খালেদ পেশাগত জীবনে একজন যন্ত্রপ্রকৌশলী এবং বর্তমানে জি-গ্যাস এলপিজিতে অপারেশন বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।