রামপাল বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া পার্টনারশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। ছবিঃ মেট্রোপলিস-
রাশিদুল ইসলাম-
ডলার ও কয়লা সংকটে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত বাগেরহাটের রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় দেড় মাস আগে ১৬ হাজার কোটি টাকার ব্যয়বহুল এ কেন্দ্রে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। এক মাস না হতেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। গত ১৮ দিন থেকে এ কেন্দ্রটি বন্ধ রয়েছে। এর ফলে দেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চল সহ ঢাকা বিভাগের একটি বড়ো অংশ শীতকালেও লোডশেডিং এর কবলে পড়েছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ সেক্টর ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পরার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া পার্টনারশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের (বিআইএফপিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আকরাম উল্লাহ বলেন, ‘’ডলার সংকটে কয়লা আনতে না পারায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে উৎপাদন শুরুর এক মাস পার হওয়ার আগেই উৎপাদন বন্ধের ঘটনা ঘটল। এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ উৎপাদন স্বাভাবিক হবে তা বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। কয়লা না পাওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রটি চালু করার সুযোগ নেই। তবে এ সময়ে রক্ষণাবেক্ষণ কাজে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে।‘’
এর আগে গত বছর ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটির প্রথম ইউনিট থেকে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। ১৭ ডিসেম্বর থেকে এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। তখন ২০২৩ সালের জুনে এ কেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট থেকে আরও বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা জানিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। যা এখন অনিশ্চয়তার পথে।
রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক (সিকিউরিটি ও প্রশাসন) ওয়ালি উল্লাহ বলেন,’’কয়লা শেষ হওয়ায় গত ১৪ জানুয়ারি শনিবার সকাল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কয়লা আসলে আবারও উৎপাদন শুরু হবে। তবে কবে নাগাদ কয়লা আসবে, বা আসতে পারে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট করে তিনি কিছু বলতে পারেননি।’’
তাপ বিদুৎ কেন্দ্রের একটি সূত্র জানায় ‘ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়লা আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুমোদন দিতে দেরি করছে। ঋণপত্র খুলতে না পারার বিষয়টি চিঠি দিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) জানিয়েছে বিআইএফপিসিএল। ১০ ও ১১ জানুয়ারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি।’
বিআইএফপিসিএলের উপ-মহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল আজিম বলেন, ‘কয়লা না থাকায় গত ১৪ জানুয়ারি শনিবার সকাল থেকে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কয়লা আমদানিতে ডলার প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার না দেওয়ায় কয়লা আমদানি করা যাচ্ছিল না। তবে আমরা দ্রুত এ সংকট নিরসনের চেষ্টা করছি।’
২০১০ সালে ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং ভারতের এনটিপিসি লি. এর মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল) নামে কোম্পানি গঠিত হয়। এই কোম্পানির অধীনে ১৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট (রামপাল) নামে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শুরু হয়।
রামপাল উপজেলার রাজনগর ও গৌরম্ভা ইউনিয়নের সাপমারী কৈ-গর্দ্দাশকাঠি মৌজায় এক হাজার ৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ শেষে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শুরু হয়। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থেকে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপরই শুরু হয় জমি ভরাট ও সড়ক নির্মাণের কাজ। প্রায় ৯ বছর বিশাল কর্মেযজ্ঞ শেষে গত ১৭ ডিসেম্বর থেকে বানিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যায় প্রতিষ্ঠানটি।
এর আগে চলতি বছরের ১১ জুলাই বয়লার স্টিম ব্লোয়িং স্থাপন করা হয়। এক মাস পরে ১৪ আগস্ট টারবাইন-এ স্টিম ডাম্পিং এবং একদিন পরে ১৫ আগস্ট জাতীয় গ্রীডের সঙ্গে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবরাহ (ট্রান্সমিশন) শুরু করা হয়।
কবে নাগাদ আবার চালু হবে আলোকিত রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তা কর্তৃপক্ষ বলতে পারছে না।
বাংলাদেশে যেসব প্রকল্প নিয়ে অনেক আলোচনা এবং সমালোচনা হয়েছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তাদের মধ্যে অন্যতম। পরিবেশবাদীরা বলেছিলেন, সুন্দরবনের কাছে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হওয়ায় সেখানকার জীব-বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। কিন্তু নানা প্রতিবাদ এবং সমালোচনা উপেক্ষা করে সরকার এ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যায় ও চালু করে ।
২০১০ সালে ভূমি অধিগ্রহণ শুরুর পর ২০১২ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণ কাজ ৮৯.৫৮ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। পুরো প্রকল্পটি নির্মাণে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।