মাসুম হোসেন-
বগুড়ার এক গ্রামে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তৈরী হচ্ছে আরব দেশের ‘রাজকীয় পোশাক’ বিশত। বিশেষ এই পোশাক তৈরিতে সুতাসহ সকল উপকরণই বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। পরে এদেশের তৈরী বিশত পাঠানো হয় কাতারে। এছাড়াও সৌদি আরব, ওমান, দুবাইসহ মধ্যপাচ্যের আরও অনেক আরব দেশগুলোতে বগুড়ার বিশত রফতানি করা হয়। এতে দেশে বাড়ছে বৈদেশিক মূদ্রা আয়।
বগুড়ার সদরের এরুলিয়া ইউনিয়নের বানদিঘী হাঁপুনিয়া গ্রামে রয়েছে বিশত তৈরীর কারখানা। এই প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘বেস্ত আল-নুর এন্টারপাইজ’। ২০১৩ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন নুর আলম এক ব্যক্তি।
বেস্ত আল নুর এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক মোঃ মানিক পাইকার বলেন, ‘প্রায় ২৭ বছর আগে জীবিকার তাগিদে সৌদি আরবে পাড়ি জমান প্রতিষ্ঠানটির মালিক নুর আলম। সেদেশে বিশত তৈরীর এক কারখানায় কাজ শুরু করেন তিনি। সৌদি আরবে বছর পাঁচেক কাজ করেন তিনি। এরমধ্যেই বিশত তৈরীতে দক্ষ হয়ে উঠেন নুর আলম। পরে সৌদি আরব থেকে কাতারে যান তিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কাতারের ‘বিশত আল সালেহ’ নামে প্রতিষ্ঠানে চাকরি শুরু করেন নুর আলম। এক পর্যায়ে ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে নিজ দেশের নিজ জেলায় ফিরে এসে বিশত তৈরী করা শুরু করেন। একই সঙ্গে নিজের কারখানায় তৈরী করা বিশত কাতারের বিশত আল সালেহ প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন। বর্তমানে তাদের প্রতিষ্ঠানে ৩০ জন কারিগর রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১৪ জন নারী ও ১৬ জন পুরুষ।’
কারিগররা বলেন, প্রথমদিকে ১০-১২ জনকে নিয়ে বিশত তৈরীর প্রশিক্ষণ করান নুর আলম। তাদের প্রশিক্ষিত করার পর থেকেই বিশত তৈরী করে কাতারে রফতানি শুরু করা হয়। নুর আলম কাতারের বিশত আল সালেহ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। তবে বর্তমানে ওই প্রতিষ্ঠানে শুধু বিশত সরবরাহ করেন তিনি। একারণে বছরের এক থেকে দুইবার কাতারে যান নুর আলম।
বেস্ত আল-নুর এন্টারপাইজের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কারিগর হিসেবে কাজ করছেন শাকিল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সাধারণত মাসে ৪০-৪৫ পিস বিশত তৈরী করা হয়। ৫০ হাজার টাকা থেকে ৯০ হাজার টাকায় প্রতিটি বিশত বিক্রি করা হয়। এছাড়াও প্রয়োজন অনুযায়ী মাসে বিশত তৈরীর সংখ্যা বাড়ানো হয়। একই সাথে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন দামের বিশত তৈরী করা হয়।’
কারিগররা বলেন, বিশত তৈরীর উপকরণ স্বর্ণ ও রৌপ্য প্রলেপযুক্ত সুতা, জরি ও নরম পাতলা কাপড় ব্যবহার করা হয়। এসব উপকরণ আমদানি করতে হয়। তুরস্ক, ভারত, সিরিয়া থেকে বিশত তৈরির উপকরণ নিয়ে আসা হয়। আর বিশত’র কাপড় জাপানের। মাঝে মধ্যে সৌদি আরব থেকেও বিশত’র কাপড় আমদানি করা হয়।
কারিগর শাকিল হোসেন বলেন, ‘বছর পাঁচেক আগে কারখানায় নারী কারিগর নেয়া হয়। তারা প্রতিমাসে ১২-১৪ হাজার টাকা আয় করেন। আর পুরুষ কারিগররা ২২-২৪ হাজার টাকা আয় করেন।’
কারিগররা বলেন, একটি বিশত তৈরি করতে সাতটি ধাপ পার করতে হয়। প্রথমে বাতানার কাজ করতে হয়। এরপরে জরির কাজ। যাকে বলা হয় হেলা। পরে ধাপগুলো পর্যায়ক্রমে তুক্ত স্রিপ, ব্রুজ, মাসকার, বরদাক ও সিলালা। এরপরেই তৈরী হয় বিশত। একটি বিশত তৈরী করতে সাতজন কারিগরের একটি দলের সাত দিন সময় লাগে। তবে বর্তমানে চাহিদা অনুযায়ী বিশত তৈরী এবং রফতানি করা হচ্ছে। তাদের তৈরী বিশত কাতার, সৌদি আরবসহ মধ্যপাচ্যের অনেক আরব দেশে পাঠানো হয়।
বেস্ত আল-নুর প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক মোঃ মানিক পাইকার বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী বিশত তৈরী করে কাতারের ‘বিশত আল সালেহ’ প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন তারা। সেখান থেকে সৌদি আরবসহ অনেক দেশে তাদের তৈরী বিশত বিক্রি হয়। বিশত আল সালেহ প্রতিষ্ঠানটি নিজস্বভাবে বিশত তৈরী করেন। পাশপাশি আমরাও ওই প্রতিষ্ঠানে বিশত সরবরাহ করি। এছাড়া চাহিদা অনুযায়ী মধ্যপাচ্যের বিভিন্ন আরব দেশে আমরা বিশত রফতানি করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশতকে আরব দেশগুলোতে সাধারণত ‘রাজকীয় পোশাক’ বলা হয়। কাতার সৌদি আরবসহ মধ্যপাচ্যের অন্য দেশের সম্মানিত ব্যক্তিরা বিশত পরেন। এছাড়াও বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে আরব দেশগুলোতে এই পোশাক ব্যবহার করা হয়।’