শ্বেতশুভ্র বরফে আচ্ছাদিত তিব্বত, যেখানে শ্বাস নেওয়া এক চ্যালেঞ্জ, সেখানেই হাজার হাজার বছর ধরে এক পারমার্থিক ধর্ম টিকে আছে। এই রহস্যময় ধর্মের নাম ‘বন’, যা তিব্বতের পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ধর্ম হিসেবে পরিচিত। বৌদ্ধধর্মের আগমনের আগেই তিব্বতে বন ধর্মের রীতি চালু ছিল, এবং এটি প্রায় ৩০০০-৪০০০ বছর পুরনো বলে ধারণা করা হয়।
বৌদ্ধধর্মের আগের ধর্ম
তিব্বতের অধিকাংশ অঞ্চলে বর্তমানে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব রয়েছে। কিন্তু তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের আগমনের পূর্বেই বন ধর্মের রীতিনীতিগুলি প্রচলিত ছিল। যদিও বন ধর্মের সঠিক বয়স জানা যায়নি, তবে কিছু সূত্র অনুযায়ী খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দেও এটি বিদ্যমান ছিল। ‘বন’ শব্দটি বনপো ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘দেবতাদের আহ্বান করা’। ধর্মটির প্রাচীনত্বের কারণে এর মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে, বিশেষত বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে এই ধর্মে দুটি শাখা গড়ে উঠেছে: প্রাচীন বন এবং নয়া বন।
সর্বপ্রাণবাদ: প্রকৃতির সাথে এক অমিত সম্পর্ক
বন ধর্মের মূল তত্ত্ব হলো সর্বপ্রাণবাদ, যার মতে, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু—পাথর, গাছ, প্রাণী বা মানুষ—সমস্তই আধ্যাত্মিক শক্তি ধারণ করে। এই শক্তি প্রতিটি সত্ত্বাকে জীবনীশক্তি প্রদান করে এবং তাদের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক সৃষ্টি করে। বন ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, এই আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে মহাজগতের প্রতিটি সত্ত্বা একে অপরের সাথে সংযুক্ত। প্রকৃতির প্রতি তাদের এক গভীর আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে, যার মাধ্যমে তাঁরা বিশ্বজনীন ভারসাম্য এবং ঐক্য ফিরিয়ে আনার প্রার্থনা করেন।
বহুদেববাদী ধারণা
বন ধর্মে বহু দেবতাও রয়েছে। প্রতিটি দেবতা প্রকৃতির বিভিন্ন দিককে প্রতিনিধিত্ব করে। অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, এই দেবতারা মহাবিশ্বের সঠিক পরিচালনা ও পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য দায়িত্ব পালন করছেন। বন ধর্মের প্রধান দেব-দেবীরা হলেন:
-
সাতরিগ এরসাং – প্রধান দেবমাতা, যার নাম ‘প্রজ্ঞা’ এবং যিনি জ্ঞানের দেবী ‘শেরাব ছাম্মা’ নামে পরিচিত।
-
শেনলাহ ওকার – আলোর ও জ্ঞানের দেবতা, যিনি আকাশ এবং আবহাওয়ার নিয়ন্ত্রণকর্তা।
-
সাংপো বুমত্রি – সৃষ্টির দেবতা, যিনি বন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত।
-
তনপা শেনরাব মিউছি – পথপ্রদর্শক, যিনি বন ধর্মের আচার অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিব্বতের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে সম্মানিত হন।
অশরীরী আত্মা ও প্রেতাত্মায় বিশ্বাস
বন ধর্মে বহু অপদেবতা, পিশাচ এবং আত্মা রয়েছে, যারা বিশেষ স্থান ও সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মধ্যে ল্হা, এক শান্তিপূর্ণ আত্মা, পর্বত, নদী এবং হ্রদে বাস করে। এই আত্মা, যে স্থানগুলিতে থাকে, সেখানে অলৌকিক শক্তির প্রয়োগ করতে সক্ষম। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আত্মা হলো সেন, যিনি ভূমির রক্ষক এবং স্থানীয় জনগণের সুরক্ষা দেবতা হিসেবে পূজিত হন।
এছাড়া আগইয়ে নামক এক পিশাচ, যা রোগ ও অশান্তির জন্য দায়ী, তার প্রতি বন ধর্মের লোকেরা বিশেষ সজাগ থাকে। তাকে ভয়ঙ্কর এক পৈশাচিক সত্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যার মাথায় খুলির মুকুট এবং শরীরে বিশাল সাপ জড়ানো থাকে।
মৃত্যু ও পুনর্জন্মের মহাজীবন চক্র
বন ধর্মে মৃত্যুকে জীবনের সমাপ্তি হিসেবে না দেখে বরং এটি এক স্বাভাবিক চক্র হিসেবে গৃহীত হয়। এই ধর্ম মতে, মৃত্যুর পর আত্মা এক বিশেষ অবস্থানে, ‘বার্ডো’তে পৌঁছায়, যেখানে সে ৪৯ দিন থাকে। এই সময়কালে আত্মা শান্তিপূর্ণ এবং ক্রোধপূর্ণ অবস্থা সহ বিভিন্ন আধ্যাত্মিক সত্তার সাক্ষাৎ লাভ করে, এবং পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুত হয়।
বন ধর্মে নরক নামক কোন ধারণা নেই। জীবনকালে একে অপরের প্রতি করা কর্মই পরবর্তী জীবনে আত্মার পথ নির্ধারণ করে। ভালো কর্মের জন্য আত্মা পুনর্জন্মে মানব, প্রাণী, গাছ হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে, তবে খারাপ কর্মের জন্য আত্মা দুঃখ-দুর্দশায় ভুগতে পারে।
জাদুবিদ্যা ও মন্ত্র: আধ্যাত্মিক শক্তির এক মূর্ত প্রকাশ
বন ধর্মে জাদুবিদ্যা ও মন্ত্রের ব্যবহারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ‘ফোয়া’ নামে পরিচিত বন ম্যাজিকের মাধ্যমে তান্ত্রিকেরা দেবতাদের, আত্মাদের এবং পিশাচদের প্রভাবিত করেন। বন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, মন্ত্র এবং জাদু শক্তি শারীরিক এবং মানসিক রোগ নিরাময় করতে সক্ষম। প্রাকৃতিক এবং আধ্যাত্মিক শক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে বন ধর্মের অনুসারীরা প্রকৃতির শক্তির সাথে এক অটুট যোগ স্থাপন করেন।
এভাবে তিব্বতের বন ধর্ম, এক রহস্যময় এবং অমলিন আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য হিসেবে, তাদের সমাজে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে।
Source- Roar Bangla
This article is packed with great information and is very helpful.
The website is an excellent resource for learning.
Thanks a lot! Please be cooperative with us! we are trying to develop our content quality day by day.