মোঃ মেহরাব হোসেন ভূঁইয়া –
প্রকৃতি হলো মানবজাতির বিকাশের মূল উপাদান যাকে পুঁজি করে গড়ে উঠেছে সমস্ত কিছু। প্রকৃতির সব কিছুতেই আমরা ভাগ বসাই, অথচ প্রকৃতিকে কিছু দেয়ার কথা আসলে তখন আমরা ন্যায়বিচার ভুলে নির্বাক হয়ে বসে থাকি। আমরা যেন ভুলেই গেছি প্রকৃতির জন্যই আমরা টিকে আছি। আজ যখন প্রকৃতি বিপন্ন তখন আমরা সবাই এমনভাবে বসে আছি যেন কিছুই হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাড়তে থাকা জনসংখ্যার চাপ, ব্যাপক হারে বন উজাড়, বন্যপ্রাণী শিকার, নদীর নাব্যতা হ্রাস, ভারসাম্যহীন পরিবেশ, অবহেলা ও অযত্নের কারণেই বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ, বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে নানা প্রজাতির প্রাণী। হারিয়ে যাচ্ছে নানা জাতের গাছ ও মাছ। পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে একটা সময় হয়ত জীববৈচিত্র্য শূন্য হয়ে পড়বে দেশ। ২০১৯ সালের জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১০ প্রজাতির গাছপালা এবং প্রাণী বিলুপ্তির ঝুঁকিতে ছিলো। ১৭৫০ সাল থেকে কমপক্ষে ৫৭১ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ একটি স্বল্প আয়তনের দেশ হলেও এখানে রয়েছে বিপুল জীববৈচিত্র। পরিবেশ বিপর্যয়ে সারা পৃথিবীর মত আমাদের জীববৈচিত্র্যও আজ হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। যেখানে এক সময় ছিলো জীববৈচিত্র্যের অসীম সমারোহ, আজ তার চিত্র অনেকাংশেই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগ এবং প্রাকৃতিক সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) ২০১৫ সালে বাংলাদেশের ১ হাজার ৬১৯ প্রজাতির বন্য প্রাণীর কোনটির কি অবস্থা, সে বিষয়ক লাল তালিকা বা রেড লিস্টের হালনাগাদ প্রতিবেদন তৈরি করে। ২৫৩ প্রজাতির মাছ, ৪৯ প্রজাতির উভচর, ১৬৭ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৬৬ প্রজাতির পাখি, ১৩৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৪১ প্রজাতির পোকামাকড় এবং ৩০৫ প্রজাতির প্রজাপতির উপর জরিপ চালিয়ে দেখা যায় এর মধ্যে ৩৯০ টি প্রজাতিই কোন না কোন ভাবে বিপন্ন যার মধ্যে ৩১ টি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
আইইউসিএন-এর তালিকায় দেখা যায়, গত ১৫ বছরে সবচেয়ে বেশি বিলুপ্ত হয়েছে পাখি। এদের প্রধান খাবার হচ্ছে শস্য দানা ও কীটপতঙ্গ। কৃষকরা জমির ফসল পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করতে জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করে, এর কারনে ক্ষতিকর পোকার সাথে সাথে অনেক উপকারী পোকামাকড়ও মারা যাচ্ছে এবং জমিতে শস্য দানা খেতে আাসা পাখিও কীটনাশকের কারণে মারা যাচ্ছে। পাখি বিলুপ্তির আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে পাখি শিকার ও পাখি ব্যবসা। দেশের ৫৬৬ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৯ টি গত ১০০ বছরের মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই বিলুপ্তির দৌড়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্তন্যপায়ী প্রাণী, এটি হারিয়েছে ১১ প্রজাতি। আর সরীসৃপ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে ১ টি।
এছাড়া মহাবিপন্ন প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হাতি, ভোঁদড়, লামচিতা, চিতা, বনরুই, উল্লুক, চশমা পরা হনুমান, বন গরু, সম্বর হরিণ, প্যারাইল্লা বানর, হিমালয়ান ডোরাকাটা কাঠবিড়ালি ও কালো ভাল্লুক।
পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে এসব প্রাণীদের আর কখনো দেখা যাবে না। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত নাম হচ্ছে ডাইনোসর। শুধু ডাইনোসর নয়, গত ৫০ কোটি বছরে পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে ৪ হাজার প্রজাতির প্রাণী। এক সময় গনমৃত্যুর কারণে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হলেও বর্তমান সময়ে বিলুপ্ত হয় প্রধানত জলবায়ুগত ও ভৌগোলিক কারণে। মেক্সিকোর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটিতে ২৭ হাজার মেরুদণ্ডী প্রাণীর উপর গবেষণা করে দেখা গেছে, এসব প্রাণীর সংখ্যা অর্ধেকে কমে এসেছে। আবার টিকে থাকা প্রাণীর বংশবিস্তারও ৩৭ শতাংশ হারে কমে গেছে।
ঠিক এভাবেই বাংলাদেশ থেকেও বেশ কয়েকটি প্রাণী চিরতরে বিলুপ্তি হয়েছে। যেমন, বাংলাদেশে এক সময় দেখা মিলতো এশিয়া মহাদেশীয় সুমাত্রান ও জাভাদেশীয় তিন রকম গন্ডার, কিন্তু এখন এটি চিরতরে হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশে আরো একটি প্রচলিত প্রাণী হচ্ছে গৌর বা বন গরু যেটি ঢাকা ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে দেখা মিলতো। মানুষ মাংসের জন্য এটি গনহারে শিকার করতে শুরু করলে এক পর্যায়ে এসে এটি বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়। সর্বশেষ ১৯৭১ সালে টেকনাফ অঞ্চল থেকে শেষ গৌরটি শিকার করা হয়। ১৯৪০ সালে সুন্দরবনে দেখা মিলতো বন্য মহিষের, কিন্তু সেটিও গনহারে শিকারের কারণে বিলুপ্ত হয়েছে। এই রকম আরও অনেক প্রাণী বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে, যদি আমার সচেতন না হই ভবিষ্যতেও হয়ত আরও অনেক বিলুপ্তি ঘটতে থাকবে।
বন্য প্রাণী বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হলে প্রথমে আমাদের বন উজাড় বা গাছ কাটা বন্ধ করতে হবে। বন্য প্রাণী ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। বন্য প্রাণী ধরা বন্ধ করতে হবে। বেশী বেশী গাছ লাগাতে হবে। আমরা যদি বন্য প্রাণীদের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে না পারি তাহলে অচিরেই আমরা পৃথিবীর সকল জীববৈচিত্রের সাথে সাথে হারিয়ে ফেলবো আমাদের এই সাজানো গোছানো পৃথিবীকে। তাই ভবিষ্যত পৃথিবীর চিন্তা মাথায় রেখে আমাদের সকল বন্যপ্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসতে হবে।