back to top
3.4 C
New York
Tuesday, December 3, 2024

TMN Shop

spot_imgspot_img

বাংলাদেশে এলএনজিঃ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ

প্রকৌ. শাণিতা সাফওয়াত

বাংলাদেশে জ্বালানি হিসেবে প্রাইমারি এনার্জির চাহিদার প্রায় ৫০% প্রাকৃতিক গ্যাস (Natural Gas) যোগান দেয়। এই প্রাকৃতিক গ্যাস এর তাপমাত্রা প্রায় -১৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে পরিণত করলে তা তরলীকৃত হয়, যা এলএনজি (Liquefied Natural Gas) নামে পরিচিত। এ সময় এর আয়তন প্রায় ৬০০ গুন কমে যায়, ফলে তা পরিবহন করা সুবিধাজনক। এই এলএনজি এক স্থান থেকে দূরবর্তী অন্য স্থানে সমুদ্রপথে পরিবহনের জন্য বিশেষায়িত জাহাজ (LNG Carrier) ব্যবহার করা হয়, যেখানে এলএনজি স্টোরেজ ট্যাংক এর ব্যবস্থা থাকে। পরবর্তীতে পরিবহনকৃত এলএনজি সরবরাহের জন্য নির্ধারিত স্থানে বিশেষ টার্মিনাল এর মাধ্যমে পুনরায় গ্যাস-এ পরিণত করে প্রাকৃতিক গ্যাস এর চাহিদার বিপরীতে আরএলএনজি (Regasified LNG) সরবরাহ করা ও প্রয়োজনীয় জ্বালানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। 

দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানির চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট তারিখে মহেশখালীতে এলএনজি (MLNG)  টার্মিনালের কমিশনিং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ এলএনজি যুগে প্রবেশ করে। এর পূর্বেই ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (FSRU) ও এর অবকাঠামো নির্মাণ, অপারেশন এবং পরবর্তীতে মালিকানা হস্তান্তরের জন্য দুইটি কোম্পানি  Excelerate Energy Bangladesh Limited (EEBL) এবং Summit LNG Terminal Co. (Pvt) Ltd (SLTCPL) এর সাথে পেট্রোবাংলার  দীর্ঘমেয়াদী ২ টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রায় একই সময়ে  কাতারের Ras Laffan Liquefied Natural Gas Co. Ltd (3) এবং ওমানের OQT এর সাথে এলএনজি আমদানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৯ সালে মহেশখালীতে সামিট এলএনজি (Summit LNG) টার্মিনালের কমিশনিং এর মাধ্যমে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ২ টি টার্মিনাল সক্রিয়ভাবে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা কাজ করে আসছে এবং বাংলাদেশে আমাদানিকৃত এলএনজি রি-গ্যাসিফিকেশনের মাধ্যমে  আরএলএনজি (Regasified LNG) জাতীয় গ্যাস গ্রিডের সহায়তায় সারা দেশে সরবরাহ করছে। বর্তমানে ২টি টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন ১১০০ এমএমএসসিএফ আরএলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া এই টার্মিনালগুলোতে এলএনজি স্টোরেজও করা সম্ভব। এলএনজি আমদানির কারণে গ্যাস-ভিত্তিক শিল্প-কারখানায় ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহে গ্যাস সংকট নিরসন করা সম্ভব হয়েছে এবং চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে।

সারাদেশে গ্যাসের চাহিদা অনুসারে দেশীয় উৎপাদিত গ্যাসের পাশাপাশি কতটুকু এলএনজি আমদানি করা প্রয়োজন তা প্রতি বছরের শুরুতেই নির্ধারণ করা হয়। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির পাশাপাশি স্পট মার্কেট থেকেও এলএনজি কেনার জন্য বিভিন্ন সময়ে একাধিক এলএনজি সরবরাহ কোম্পানির সাথে চুক্তি করা হয়েছে। একারণে বছরের শুরুতে বাৎসরিক কার্গো সংখ্যা নির্ধারণ করা হলেও চাহিদা বেশি থাকলে কিংবা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় থাকা কোম্পানিসমূহের কার্গোর মূল্য বেশি হলে বিশ্ববাজারে স্পট কার্গো মূল্য বিবেচনায় নিয়ে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কার্গো কেনার সুযোগ রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় স্পট কার্গো চুক্তির আওতায় ২০২০-২০২১ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশের জন্য এলএনজি কার্গো কেনা হচ্ছে। দেশের এলএনজির এই চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৩ সালে Qatar Energy Trading LLC, OQ Trading Ltd (OQT) এবং Excelerate Gas Marketing Partnership Limited (EGMLP) এর সাথে ৩ টি দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানি চুক্তি করা হয়, যার আওতায় ২০২৬ সাল থেকে এই ৩ টি কোম্পানি হতে এলএনজি আমদানি করা যাবে। একই সাথে ২০২৪ সালে Summit Oil & Shipping Co. Ltd (SOSCL) এর সাথে পেট্রোবাংলার অপর একটি দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানি চুক্তি হয়েছে, যার আওতায় ২০২৬ সাল থেকে এলএনজি আমদানি করা যাবে। এছাড়া, বর্তমানে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী ভিত্তিতে বিভিন্ন কোম্পানি হতে এলএনজি আমদানির প্রস্তাব বিবেচনা করা হচ্ছে এবং এ বিষয়ে চুক্তির জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে নেগোসিয়েশন চলছে। এলএনজি আমদানি সক্ষমতা বাড়ানোর এই প্রয়াস দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধির একটি অংশ।

এলএনজি আমদানি বৃদ্ধির প্রচেষ্টার পাশাপাশি এলএনজি রি-গ্যাসিফিকেশন টার্মিনাল ক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টাও চলছে। ২০২৪ সালে মহেশখালীতে ৬০০ এমএমএসসিএফডি ক্ষমতাসম্পন্ন ৩য় একটি FSRU নির্মাণের জন্য Summit Oil & Shipping Co. Ltd (SOSCL) এর সাথে পেট্রোবাংলার একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে, যার আওতায় ২০২৬ সালে FSRU টি কমিশনিং করার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া পটুয়াখালীর পায়রায় ৪র্থ একটি FSRU নির্মাণের জন্য Excelerate Global Operations LLC এর সাথে একটি Non-binding চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। দেশের গ্যাসের চাহিদার প্রেক্ষিতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ সংক্রান্ত সুবৃহৎ পরিকল্পনার একটি অংশ হচ্ছে কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে ১০০০ এমএমএসসিএফডি ক্ষমতাসম্পন্ন ‘বঙ্গবন্ধু এলএনজি ল্যান্ডবেইজড টার্মিনাল’ নির্মাণ। এছাড়া, ভারত থেকে ক্রসবর্ডার পাইপলাইনের মাধ্যমে আরএলএনজি আমদানির প্রস্তাব রয়েছে। এলএনজি/আরএলএনজি স্থাপনা নির্মাণ, আমদানি, মজুদ, রি-গ্যাসিফিকেশন ও সরবরাহসহ সকল কর্মকান্ডে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের সুবিধার্থে সরকার ‘বেসরকারি খাতে এলএনজি/আরএলএনজি স্থাপনা নির্মাণ, আমদানি ও সরবরাহ নীতিমালা-২০১৯ (সংশোধিত ২০২৩)’ প্রণয়ন করেছে।

বর্তমানে দেশে গ্যাস সরবরাহের ২৫-৩০% সরবরাহ করা হচ্ছে এলএনজি হতে, যা জ্বালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধির নামান্তর। উদাহরণস্বরুপ, গত ২৭ এপ্রিল ২০২৪ তারিখের পেট্রোবাংলার দৈনিক প্রতিবেদন হতে দেখা যায়, এদিন এলএনজি হতে গ্যাস সরবরাহের হার ছিলো মোট গ্যাস সরবরাহের প্রায় ৩৫%। দেশীয় উৎপাদিত গ্যাসের রিসার্ভ কমতে থাকায় বিকল্প গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার, আবিষ্কৃত কুপ খনন এবং অফশোরে গ্যাস অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা একই সাথে চললেও এগুলো দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যে দেশে জ্বালানির তীব্র চাহিদার ভিত্তিতে যোগান অব্যাহত রাখতে আমাদের এনার্জি-মিক্স নীতিতে এলএনজির অবদান অস্বীকার করার সুযোগ নেই। চারদিকে যখন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে কর্মযজ্ঞ চলছে, তখন এ কথা মনে রাখতেই হবে এলএনজি একটি লো-কার্বন ফুয়েল, যা বর্তমানে পৃথিবীর বহু দেশে Energy Transition এর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হছে। অতএব, জলবায়ু রক্ষায় বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য এলএনজি একটি বড় ভুমিকা রাখছে। 

প্রকৌ. শাণিতা সাফওয়াত আরপিজিসিএল-এর উপব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) পদে কর্মরত আছেন। 

Related Articles

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

3,800FansLike
300FollowersFollow
250SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles