রাশিদুল ইসলাম –
‘আগে শিঙা লাগাতাম, মানুষ তেমন গুরুত্ব দিত না। পেতাম ১০০-৩০০ টাকা। এতে আমাদের হতো না। নুন আনতে পান্তা ফুরাতো। এখন আমরা ব্যাবসা করি। শাড়ি-কাপড় বিক্রি করি। আগে মানুষ আমাদের জায়গা দিত না। এখন সবাই আমাদের স্নেহ করে, ভালোবাসে। ডেকে মানুষ ঘরের ভেতরেও নেয়। এখন আয়ও বেড়েছে।’
এভাবেই এই প্রতিবেদককে কথাগুলো বলছিলেন খুলনার জোড়াগেট এলাকার গ্রিনল্যান্ড পল্লিতে থাকা বেদে সম্প্রদায়ের লাকী বেগম।
লাকী বলেন, “আমি কাজে গেলে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা লাভ থাকে। এই টাকা দিয়ে আমি আবার কাপড় আনি আর বিক্রি করি। এখন অনেক সুবিধা আছে।“
শুধু লাকী বেগমই নয়, তার মতো যাযাবর জীবন ছেড়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরছে বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা। বিভিন্ন জনপদে ঘুরে ঘুরে সাপের খেলা দেখানো, শিঙা লাগানোর কাজ ছেড়ে এখন নিজেরাই হয়েছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। এক সময়ের যাযাবর বেদে সম্প্রদায়ের এখন স্থায়ী বসতি গড়েছে বিভিন্ন জেলায়। একইসঙ্গে এই সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে অবসান হয়েছে শিক্ষাহীনতার। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে তাদের নতুন প্রজন্ম। প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পেরিয়ে তাদের অনেকে এখন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত।
খুলনার বেদে সম্প্রদায়ের মেয়ে ইসমা খাতুন বলেন, “আমার বাবা-মা সাপের খেলা দেখাত, শিঙা লাগাত, দাঁতের পোকা ফেলত। তারা অনেক কষ্ট করেছে, তাই তারা চেয়েছিলেন তাদের ছেলে মেয়েকে এই পেশায় রাখবেন না। যার জন্য তারা স্থায়ী বসতি গড়ে আমাদের ৬ ভাই-বোনকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। আমার ভাই এসএসসি পরীক্ষা দেয়নি শুধুমাত্র অর্থের জন্য। এখন সে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করে।
তিনি বলেন, আমার বাবা-মা জানতেন এটা কোনো জীবন না, ওই কাজ করলে প্রতিনিয়ত অপমানিত হতে হয়, সবাই উপহাস করে। আমি মনে করি এখনও যারা ওই করে তারা যেন ছেড়ে দেয়।
ইসমা আরও বলেন, “আমার স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব। আমরা ৬ ভাই-বোন। আমার মা-বাবার তেমন আয় ছিল না। আমাদের কষ্ট হয়েছে। তাই আমরা চাই আমাদের পরের প্রজন্ম যেন মাথা উঁচু করে বাঁচে।আমাদের সস্প্রদায়ের অনেকেই এখনও আগের পেশায় রয়েছে। আমরা অনেকে সুযোগ পেয়েছি, তারা হয়তো সুযোগ পাচ্ছে না।“ সবাই সুযোগ পেলে সমাজের মুল ধারায় ফিরবে বলে তিনি আশাবাদী। কাজের পাশাপাশি তিনি ছোটো চার ভাই-বোনের পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছেন।
এদিকে খুলনার ওই বস্তির বেদে সম্প্রদায়ে অধিকাংশ মানুষ এখন বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়ে ছোটো উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন। তাদের দেখাদেখি এখনও যারা বেদেদের আদি পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন তারাও উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করছেন।
বেদে সম্প্রদায়ের উদ্যোক্তা কেয়া খাতুন বলেন, “আগে আমার বাবা-মা শিঙা লাগাতো। এখন আর এসব করে না। সহায়তা ও প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর কেউ কাপড়ের ব্যাবসা করে, কেউ ব্যাগের ব্যাবসা করে। আগের ওই কাজ করলে সমাজে মানুষের কাছে মূল্য পাওয়া যায় না, মানুষ মিশতেও চায় না। এখন মর্যাদা পাওয়া যায়।“
কেয়া বলেন, “আমি আগে অন্যের ওখানে ব্যাগ বানাতাম। এখন নিজের কাজ নিজে করি। গড়ে তুলেছি সানজিদা ব্যাগ ঘর। এখানে আমার সাথে আরও ২ জন কাজ করে। এখন ভালো আছি। ভবিষ্যতে এর চেয়ে ভালো পর্যায়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া শেখাব, যেন তারা কষ্ট না করে। ভালো পর্যায়ে যায়, চাকরি করে।“
বেদে ওমর ফারুক বলেন, “আগে শিঙা লাগাতাম, সাপের খেলা দেখাতাম। কাজ ভালো ছিল না, ঝুঁকি ছিল। মানুষ ধিক্কার ও বেশি বেশি সমালোচনা করত। খারাপ জানত, অনেকে রাগ করে তাড়িয়ে দিত, অপমান করত। তাই আমরা চাচ্ছিলাম যে, এই কাজ যাতে আমরা না করি। । আমরা যে কাজ করেছি তা যেন ছেলে মেয়ে না করে সে জন্য এখন অন্য পেশায় আছি। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে পেরে উঠছি না এখন আমি শাড়ি-কাপড় বিক্রি করছি। এতে ৫০০ টাকা বিক্রি করলে ২০০-৩০০ টাকা আয় হয়।“
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন সহযোগিতাই পারে অবহেলিত ও পিছিয়ে থাকা বেদে সম্প্রদায়কে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে- বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।