প্রায় মাস ছয়েক আগের কথা, তৎকালীন যেই অফিসে চাকরি করতাম সেটার অবস্থান ছিল উত্তর বাড্ডা। বিকেলের দিকে, অফিসেরই এক কাজে ধানমণ্ডি আসবো। অফিসের নিচে থেকে সিএনজি নিয়ে রওনা হলাম হাতে কিছুটা সময় রেখেই, কারণ ঢাকার ট্রাফিকের ওপর হয়ত এখন আর আমরা কেউই ভরসা করতে পারিনা। প্রযুক্তির বিস্ময় ‘গুগল ম্যাপস’ এর দেয়া অনুমানও সবসময় কাজ করেনা। তারপর প্রায় অর্ধেক ঢাকা পেরিয়ে গন্তব্যের বেশ কাছাকাছি এসেই আমাদেরকে পার হতে হবে একটা ক্রসরোড, যার একদিক দিয়ে আমি অন্যপাড়ে যাব আর অন্য রাস্তাটাই মিরপুর রোড। অফিস ছুটির আগের শেষ কিছুটা সময় জন্য সিএনজি চালক ডান বাম না দেখেই দিলেন জোরে একটা টান। লক্ষ্য একটানে ওপার চলে যাওয়া। জানিনা ভাগ্য কতখানি সহায় ছিল, নয়ত ওপারের বদলে সেদিন পরপারে যাবার যোগাড় হচ্ছিল। কারণ অন্য রাস্তাটা দিয়ে মোটামুটি একই গতিতে আসা প্রাইভেট কারের ঢাক্কায় আমার সিএনজি সেদিন উলটে যায়। আমি আর সিএনজি চালক উভয়েই আহত হই। প্রাণে বেঁচে গেলেও সেদিনের সেই ঘটনা আমার স্মৃতিতে গেঁথে যায় পাকাপোক্তভাবে।
আমরা হয়ত জাতিগতভাবেই কিছুটা ডানপিটে, নিয়ম ভাঙতে পছন্দ করি। প্রতিনিয়ত আমরা দেখতে পাই রাস্তায় কেবল নিয়ম বহির্ভুত চলাচল আর বেপরোয়া গাড়িচালনার কারণেই শত শত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। আহত হচ্ছে তার থেকেও অধিক মানুষ। তারপরেও আমরা নিয়ম মানতে চাইনা। আমাদের কীসের যেন তাড়া! তবে আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, রাস্তায় আমাদের তাড়া দেখে সবার ই মনে হতে বাধ্য যে আমরা নিশ্চয়ই অনেক সময়ানুবর্তী। অথচ সময়মত পৌঁছানো নিয়ে আমাদের খ্যাতির কথা (তা সে সুখ্যাতি হোক বা কুখ্যাতি) আশা করি সর্বজনবিদিত!
পড়াশোনা এবং কাজের সুবাদে রাস্তাঘাট তৈরির নিয়ম, তাতে চলাচলের বিধিনিষেধ, ট্রাফিক আইন, ট্রাফিক সাইন, রোড মার্কিং ইত্যাদি নিয়ে কিছুটা জানার সুযোগ হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের রাস্তার একটা বড় অংশেই ট্রাফিক সাইন/রোড মার্কিং থাকার পরেও আমরা অনেকেই সেটা নিয়ে তেমন কিছু জানিনা বা জানার সুযোগ এলেও এড়িয়ে যাই। কথাচ্ছলে আমারই এক বন্ধু আমাকে ক’দিন আগে বলছিল রাস্তার বামপাশ দিয়ে হাঁটতে। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মটা হচ্ছে যেপাশে গাড়ি চলবে, পথচারী চলবে সেই গাড়ির চলাচলের উল্টোদিকে। অর্থাৎ আমাদের দেশের হিসেবে সেটা হতে হবে ডানপাশে। বামপাশে হাঁটলে যে নিয়মভঙ্গ হচ্ছে তা নয় কিন্তু ডানদিকে হাঁটলে আপনি গাড়ির চলাচল দেখতে পাবেন সহজে, তাই দুর্ঘটনার হার কমবে।
দীর্ঘদিন কর্মক্ষেত্র দূরে থাকার কারণে ঢাকার প্রায় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যাতায়াত করতে হয়েছে প্রতিদিনই। এই দীর্ঘ যানজটযুক্ত রাস্তায় প্রায় সবসময়েই আমার চোখে যে জিনিসটা পড়েছে সেটা হচ্ছে মানুষের অস্থিরতা। সবাই তাদের বসবাসের স্থান থেকে কাজের স্থানে বা এরই ফিরতি পথে বা কাজের প্রয়োজনেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা চলাচলের সময়ে দীর্ঘসময় ট্রাফিক জ্যামে কাটাচ্ছেন। পাবলিক বাসগুলো তো বটেই, সেইসাথে প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট হিসেবে চলা সিএনজি, প্রাইভেট কার বা মোটরবাইক ও সিগনাল ছাড়লে কেমন একটা অস্থির প্রতিযোগিতায় নেমে যান যেন এখনি একটা নির্দিষ্ট মাইলফলক পার হতে না পারলে তাকে আরো লম্বা সময় অপেক্ষার জন্য আটকে যেতে হবে। মাঝে মাঝে এই অস্থির প্রতিযোগিতা অনেকেরই প্রাণহানির কারণ হয়েছে, অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য হয়েছেন, আর আমার মত অনেকের শারীরিক ক্ষতি কম হলেও মানসিক আঘাত থেকে যায় দীর্ঘ দিন।
যখনই কোন বড় দুর্ঘটনা ঘটে আমরা সবসময়েই চালকের সেই সময়কার ভুলের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পছন্দ করি। কিন্তু নিজেরা যে প্রায় অধিকাংশ সময়েই নিয়ম মানাটা এড়িয়ে যাই এ ব্যাপারটা ভুলে যাই। আপনি, আমি সকলেই নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হলেই কিন্তু একসময় চারপাশে সচেতনতার একটা জোয়ার শুরু হবে। একদিনে এর সমাধান সম্ভব নয়। ঢাকা শহরকে বিকেন্দ্রীকরণ করা, নগর পরিকল্পনার দিকে আরো জোর দেয়া আর নিয়মের আরেকটু সুষ্ঠু প্রয়োগ হয়ত আমাদেরকে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে পারে।
শারমিন শহীদ তিষা একজন পুরকৌশলী এবং বর্তমানে বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটে জুনিয়র ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত