রাশিদুল ইসলাম-
খুলনার সুন্দরবন উপকূলের কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলায় নদীর চর দখল করে সেইসাথে ঘনবসতি এলাকা এমনকি হাসপাতাল ও স্কুলের পার্শ্ববর্তী স্থানে গড়ে উঠেছে কমপক্ষে ১৫টি অবৈধ ইটভাটা। এগুলোর প্রায় সবগুলো ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে সুন্দরবনের চোরাই কাঠ। ফলে বিপর্যস্ত হচ্ছে পরিবেশ, বাড়ছে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি। প্রশাসনের চোখের সামনে এসব ইটভাটা গড়ে উঠলেও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নামমাত্র জরিমানা ছাড়া উচ্ছেদের কোন উদ্যোগ নেই।
সরেজমিনে দেখা যায়, কয়রার আমাদী ও পাইকগাছার চাঁদখালী ইউনিয়নের মধ্যদিয়ে কপোতাক্ষ নদ মিশেছে শিবসা নদের সাথে। কালের বিবর্তনে কপোতাক্ষ ও শিবসা নদের অংশবিশেষ ভরাট হয়ে যাওয়ার সুবাদে অসাধু ব্যবসায়ীরা অবাধে গড়ে তুলছে একের পরে এক ইটভাটা। কয়রার আমাদী ইউনিয়নের নাকশা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের প্রায় ১২ একর চর দখল করে গড়ে উঠেছে তিনটি ইটভাটা। সেখানকার একরাম ব্রিকস এর পূর্ব পাশে ট্রলি থেকে বড় বড় কাঠ নামাতে দেখা যায়। বেশি ভাগই সুন্দরবনের কাঠ। আর দক্ষিণ পাশ দিয়ে ভাটার জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে কাঠ ঢুকানো হচ্ছে। একরাম ব্রিকসের পাশে রয়েছে সোহরাব ব্রিকস। সেখানেও কাঠ পোড়ানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। তারপাশে রয়েছে একেএস ব্রিকস। এটি এখন বন্ধ রয়েছে।
একই ইউনিয়নের জায়গীরমহল গ্রামে ঘনবসতি এলাকায় গড়ে উঠেছে আমির ব্রিকস। তার সন্নিকটে রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রতিনিয়ত কাঠ পোড়ানোয় এলাকার জনগণ শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বায়ু দূষণের ফলে চিকিৎসা নিতে আসা হাসপাতালের ভর্তি রোগীদেরও জটিলতা বাড়ছে। দুটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রয়েছে চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। এছাড়া বাগালী ইউনিয়নের বাগালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাশেও ছোট একটি ভাটা গড়ে উঠেছে। সেখানেও কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে।
আমাদী ইউনিয়নের উত্তর পাশে পাইকগাছা উপজেলার চাঁদখালী ইউনিয়ন। সেখানে আল্লাহর দান ভাটা, মেসার্স সামিনা ব্রিকস, বিবিএম ব্রিকস, এএস এম ব্রিকস,মেসার্স সরদার ব্রিকস ও স্টার ব্রিকস নামে ছয়টি অবৈধ ইটভাটা গড়ে উঠেছে। জানুয়ারি মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর পাইকগাছায় অভিযান চালিয়ে চাঁদখালীর ৫টি ইট ভাটাকে জরিমানা করে। এছাড়া পাইকগাছার গদাইপুর, পুরাইকাটি, রঘুনাথপুর, কপিলমুনিসহ বেশ কিছু স্থানে গড়ে উঠেছে আরও ৮ থেকে ১০টি ইটভাটা।
কয়রা ও পাইকগাছার প্রায় সবগুলো ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এসব ইটভাটার কোনটিরই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স নেই।
স্থানীয় জনগণের অভিযোগ, এসব অবৈধ ভাটায় প্রতিনিয়ত কাঠ পুড়ানো হচ্ছে। সুন্দরবনের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকার গাছপালা কেটে উজার করা হচ্ছে। ইট ভাটার ধোঁয়ায় কৃষি জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে। গাছপালা মরে যাচ্ছে। মানুষ স্বর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। বাতাসে চোখ জ্বলে। সাদা কাপড় কালচে রঙ ধারণ করে। পরিধানের পোশাকের ওপর ধুলোর আস্তরণ জমে। আশপাশের গাছপালা নষ্ট হচ্ছে। কৃষকরা ফসল ফলাতে পারছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইটভাটার এক মালিক বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অভিযানে এসে জরিমানা করা হয়। বন্ধ না করে জরিমানা করায় বরং ইটভাটার মালিকরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
চাঁদখালীর স্টার ব্রিকস এর স্বত্বাধিকারী মোঃ আব্দুল হালিম খোকন বলেন, কয়লার দাম বেশি হওয়ায় মাঝেমধ্যে কাঠ দিচ্ছি। পরিবেশের ছাড়পত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, উচ্চ আদালতে রিট করা রয়েছে।
আমাদী ইউনিয়নের একরাম ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী মোঃ একরাম সানা বলেন, মাঝেমধ্যে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। চর দখলের বিষয়ে বলেন, চরের কিছু অংশ ইট কাটার কাজে ব্যবহার করছি। নদী খনন হলেই ছেড়ে দিব। মূল ভাটা রেকর্ড করা জমির ওপর।
সোহরাব ব্রিকস ফিল্ডের স্বত্বাধিকারী সোহরাব হোসেন বলেন, প্রথমে কিছু কাঠ ব্যবহার করেছিলাম। এখন সম্পূর্ণ কয়লা ব্যবহার করছি। আর চর দখলের বিষয়ে বলেন, রেকর্ডকৃত জমির মালিকদের থেকে লিজ নিয়েছি।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মমিনুর রহমান বলেন, একটি ভাটাকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়েছে। দ্রুতই অন্যগুলোতে অভিযান চালানো হবে।
খুলনা জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোঃ আবু সাঈদ বলেন, পাইকগাছায় অভিযানের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়েছে। কয়রাতেও কিছুদিনের মধ্যে অভিযান করা হবে। পরিচালক স্যারকে বলেছি। তিনি অনুমতি দিলেই হবে। কয়রায় কোন ইটভাটার ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। পাইকগাছার ২/৩ টি বাদে সবগুলো অবৈধ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড, খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আশরাফুল আলম বলেন, নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার পরে চরের জমির মালিক লোকাল প্রশাসন। সেটি আর তখন আমাদের আওতায় থাকে না।
খুলনা বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মোঃ ইকবাল হোসেন বলেন, আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। দ্রুতই ফের অভিযান পরিচালিত হবে। সুন্দরবন উপকূলের পরিবেশ নষ্ট করে কাউকে ব্যবসা করতে দেয়া হবে না ।