বীর মুক্তিযোদ্ধা গৌর গোপাল গোস্বামী।
মাসুম হোসেন-
গৌর গোপাল গোস্বামীসহ ৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল ভারতের আসামের মাইনকারচর থেকে বগুড়ার ধুনটের উদ্দেশ্যে তিনটি নৌকা নিয়ে রওনা দেন। পরদিন সকালে তারা গাইবান্ধার ফুলছড়ি ঘাটে পৌঁছান। সেখানে দূর থেকে ভেসে আসে এক অচেনা বৃদ্ধের চিৎকার।
বৃদ্ধ বলছিলেন, সামনে মিলিটারি, সাবধান। তখনই তিনটি নৌকা ওই চরেই ভেড়ান মুক্তিযোদ্ধারা। নৌকাগুলো সেখানেই আড়ালে রেখে অবস্থান করেন তারা। এর মিনিট বিশেক পরে তাদের চোখে পড়ল পাকবাহিনীর স্পিড বোর্ড। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা মাটিতে শুঁয়ে পড়ে হানাদার বাহিনীর নজর এড়ালেন।
এভাবেই সেই বৃদ্ধের সতর্ক বার্তায় বেঁচে গেলেন সবাই। এছাড়া ভয়ানক কিছু হয়ে যেত সেদিন। ওই দিন রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করলেন মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা। যে যার মত লুকিয়ে ছিলেন। ওই দিন রাতেই পাকবাহিনী সার্চ লাইট দিয়ে আবারো নজরদারি শুরু করে। তবে সার্চ লাইট খুঁজে বের করতে মুক্তিযোদ্ধাদের। পরে ওই রাতেই ধুনটের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তারা।
যমুনা নদী পার হয়ে বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চন্দনবাইশা নামক এলাকায় আশ্রয় নেন গৌর গোপালরা। পরে তারা কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে ধুনট উপজেলার নিমগাছী, শাজাহানপুর উপজেলার খোট্টাপাড়া ও জালশুকা এলাকা রাজাকার-আলবদর মুক্ত হয়। এছাড়াও ওই সময় আশেপাশের আরও কয়েকটি এলাকা রাজাকার-আলবদর মুক্ত করা হয়।
পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১০ টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়ার গাবতলী উপজেলার বালিয়াদীঘি গ্রামে অবস্থান করছিলেন। সেখানে তারা জানতে পারেন ওই উপজেলার দড়িপাড়া গ্রামের শমসের রাজাকার বাহিনী একজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে গেছে। তাকে মিলিটারিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এমন সংবাদ পাওয়া মাত্রই টিম লিডার মাসুদুল আলম খান চান্দুর নেতৃত্বে দড়িপাড়া গ্রামে অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রাতে দড়িপাড়া উদ্দেশ্যে রওনা দেয় মুক্তিযোদ্ধারা।
রাজাকারদের আস্তানার কাছকাছি পৌঁছানো মাত্রই একজন মুক্তিযোদ্ধার রাইফেল থেকে অসাবধানতাবসত একটি গুলি বেরিয়ে যায়। গুলির শব্দ শুনে সতর্ক হয়ে যায় রাজাকার শমসের বাহিনী। তারাও শুরু করে পাল্টা গুলি ছোঁড়া। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের মধ্যে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ।
একপর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা চান্দু বুকে গুলিবিদ্ধ হন। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন গৌর গোপাল।
চান্দু তখন টিমের সদস্যদের উদ্দেশ্যে করে বলেন, ‘তোমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাও, আমাকে ছেড়ে দাও।’ একথা বলার পরপরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন চান্দু। পরে প্রায় দুই-তিন ঘণ্টা রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে আটক মুক্তিযোদ্ধাকে উদ্ধার করা হয়। পরে চান্দুর মরদেহ নৌকায় তুলে চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। ভোরে শহীদ চান্দুর ভাইয়ের কাছে তার মৃতদেহ হস্তান্তর করা হয়।
ওই দিন বিকেলে শত শত মিলিটারি চলে আসে দড়িপাড়া গ্রামে। চারদিকে শুধু গুলির শব্দ। তৎক্ষণিক নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গ্রামের ভিতর দিয়ে হেঁটে ধুনটের সুরুগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন মুক্তিযোদ্ধারা। কারণ নৌকায় গেলে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কা ছিল। পরে সুযোগমত অভিযান চালিয়ে সুরুগ্রামে রাজাকার-আলবদর মুক্ত করেন গৌর গোপালসহ অন্যরা।
দ্য মেট্রোপলিসের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় মুক্তিযুদ্ধকালীন কিছু স্মরণীয় ঘটনা এইভাবেই বর্ণনা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত পোস্ট মাস্টার গৌর গোপাল গোস্বামী। বর্তমানে তার বয়স ৭১ বছর। তিনি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। বর্তমানে তিনি সপরিবারে বগুড়া কাহালু উপজেলায় বসবাস করছেন। তার বাবার নাম মৃত বিনয় গোস্বামী। মায়ের নাম মৃত স্নেহলতা গোস্বামী।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডাকে ঘরে বসে থাকতে পারেননি ২০ বছর বয়সী গৌর গোপাল। যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে বাইসাইকেল চালিয়ে একই বছরের জুলাই মাসের শুরু দিকে বগুড়ার মাদলা এলাকা থেকে ভারতের বালুরঘাটে যান। তবে এই যাত্রাপথে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় একরাত বিশ্রাম নেন তিনি।
বালুরঘাটে পৌঁছানোর পর সেখানে তার এক আত্মীয়র বাড়িতে কয়েকদিন অবস্থান করেন। যুদ্ধের মূল প্রশিক্ষণ (অস্ত্র প্রশিক্ষণ) নেয়ার আগে দুই রিক্রডিং ক্যাম্পে ১৫-২০ দিন থাকতে হয়। এর অংশ হিসেবে তিনি প্রথমে ভারতের কুরমাইল ক্যাম্পে ১০-১২ দিন, পরে পতিরাম ক্যাম্প আরো ৭-৮ দিন ছিলেন। পরে তাকে পাঠনো হয় শিলিগুড়ির পানিহাটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। সেখানে তিনি ২৮ দিনের অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। ওই ক্যাম্পে তিনিসহ প্রায় ৩০০ জন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেন। এই প্রশিক্ষণ শেষে ২৪ জন করে একটি টিম গঠন করে দেয়া হয়। গৌর গোপালের টিম লিডার ছিলেন মাসুদুল আলম খান চান্দু।
পরে তাদেরকে প্রথমে পাঠানো হয় ভারতের রায়গঞ্জ তরঙ্গপুরে। সেখানে হিলি সীমান্তে তাদেরকে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে রেললাইন (তিন কিলোমিটার) উঁড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়। তারা তা করতে সফল হন।
এই অপারেশনের কিছুদিন পর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অস্ত্র-গুলি ও গ্রেনেড বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেয়া হয়। তাদের প্রত্যেককে ৫০ রুপি ও ৬০ টাকা দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে গৌর গোপালসহ ৫৫ জন বগুড়া ধুনট উপজেলার সুরুগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ওই গ্রামের অধিকাংশ মানুষই পাকবাহিনীর পক্ষে কাজ করছিল। গ্রামের মানুষেরা মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করত। অনেক মানুষকে তারা হত্যাও করেছে। সেখানে পাক বাহিনীর কোনো ক্যাম্প না থাকলেও রাজাকার-আলবদর বাহিনী ছিল।