back to top
22.3 C
New York
Monday, May 20, 2024

TMN Shop

spot_imgspot_img

গাজিয়ান্তেপ আর্কিওলজি মিউজিয়াম যেন এক জীবন্ত জ্ঞানকোষ!

জুয়াইরিয়া জাহরা হক –

আমি সব সময় বিশ্বাস করি যে, একটি সমৃদ্ধ এবং একই সাথে পরিপাটি জাদুঘরে বেড়ানো একটি তথ্যবহুল বই পড়ার  সমান। কৈশোর জীবন থেকেই বিভিন্ন থিমের যাদুঘরে যেতে আমার ভালো লাগে। দেশে যখন ছিলাম চেষ্টা করেছি ঢাকার সব জাদুঘর ঘুরে দেখতে। সময় পেলে তার্কিয়েতেও তেমনটা করি।  

আমাদের বাসার খুব কাছে ‘গাজিয়ান্তেপ আর্কিওলজি মিউজিয়াম’। এই দেশে পা ফেলার পর থেকেই যাব যাব করছি কিন্তু গত চার মাস আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এর বড় কারণ, টিকিটের দাম না-কি জনপ্রতি ৩৫ লিরা, বাংলাদেশি টাকায় ২০০ টাকা! পরে বুদ্ধি করে এক কাজ করলাম। ৬০ লিরা দিয়ে এক বছরের জন্য সরকারি মিউজিয়াম কার্ড করলাম যেটা পাঞ্চ করে পুরো তুর্কিয়ের সর্বমোট ৩০০টিরও বেশি জাদুঘরে এক বছরের জন্য ফ্রি এন্ট্রি পাব যত খুশি ততবার। ব্যাপারটা দারুণ না!   

এই শহরে এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হচ্ছিল। আজব-নিশ্চুপ বৃষ্টি। বাজ পড়ার দুড়ুমদুড়ুম শব্দ নেই, বাতাসে বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দে মারামারি নেই। একটানা চুপচাপ হিমশীতল বৃষ্টি। পর্দা না সরালে টের পাওয়ার কোনো উপায় থাকে না যে, বাইরে সব ব্রিস্টিস্নানে একাকার হচ্ছে। এই দৃশ্য বারান্দার থাইগ্লাসের দরজা দিয়ে দেখতে ভালো লাগে। কিন্তু বাইরে গেলে বোঝা যায় ঠান্ডা কতো প্রকার ও কী কী!

তারপরও বৃষ্টির প্রকোপ কমতেই বেরিয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য-‘গাজিয়ান্তেপ আর্কিওলজি জাদুঘর’। বাসা থেকে বেশ কাছেই।  ফোরাম নামের একটা বড়ো শপিংমল আছে তার বিপরীতে। হেঁটে গেলে ৬/৭ মিনিটের ঘটনা। 

কোমর বেঁধে জাদুঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। মাথায় সেট করে নিলাম সব সেকশন যথাসম্ভব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখব। সব বর্ণনা পড়ে নেব। শুরুর অংশে ছিল- সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ের মানুষের ব্যবহৃত জিনিস। ছিলো আপার-প্যালিওলিথিক যুগের বিভিন্ন মাপের – বিভিন্ন কাজের পাথরের আর গাছের ডালের তৈরি অস্ত্র এবং সরঞ্জাম। হাতির দাঁত,প্রাণীর ফসিল এসবও দেখেছি। 

বেশিরভাগ পর্ব বা ভাগ বা সেকশন করা হয়েছে একেকটি যুগ অথবা বিভিন্ন সময়ে গবেষকদের দ্বারা পরিচালিত খনন কাজের ওপর ভিত্তি করে। 

এরপর অনেকটা ভাগ জুড়ে ছিল বিভিন্ন যুগের তৈজসপত্র। পানি খাওয়ার মটকা, পাতিল, গ্লাস। মনে হবে যেন প্রাচীনকালের ক্রোকারিজের দোকানে ঢুকে গিয়েছি! তখন মজার একটা জিনিস খেয়াল করলাম৷ বাচ্চাকালে আমরা সবাই কমবেশি লাল মাটি দিয়ে পাতিল-ঢাকনা বানিয়েছি। এই প্রবৃত্তিটা আসলে নতুন না। হাজার-হাজার বছর ধরে মানুষ মাটি, তামা, পাথর এমন কি হাড় দিয়ে খেলনা সাইজের হাতি ঘোড়া, পুতুল, পাতিল বানিয়ে আসছে যাকে বলে ফিগারাইন (figurine)। সে সব কিছুর ধ্বংসাবশেষও আছে এখানকার সংগ্রহে। 

মাটির পিদিমগুলো দেখে বড়ো লোভ লাগল! মাটির পিদিমে সলতে বসিয়ে করে তাতে তেল ভরে আগুন জ্বালানোর কনসেপ্ট ছিল ঘরে আলো আনার সূচনায়। এই চর্চার  ওপর ভর করে পরে মোমবাতি জ্বলেছে আর তারপর এসেছে বিদ্যুতের বাতি। প্রদীপগুলো যারপরনাই সুন্দর। ব্রোঞ্জ আর সিসার তৈরি রোমান আমলের ওজন মাপার বাটখারা দেখলাম। বাণিজ্যের সাথে   ওজন মাপার প্রথম যন্ত্র দাড়িপাল্লার সম্পর্ক সব সময়ের। দাড়িপাল্লার আংটা মেয়েদের স্তনের আকারের যা সততার দেবী এথেনাকে মনে করে বানানো হয়েছিল। 

এরপরের অংশে ছিল পাথরের ওপর খোদাই করে হাইয়েরোগ্লিফিক ভাষার লিপি। ৮ম শতাব্দীর হাট্টিটি পিরিয়ডের। অর্থো-স্ট্যাটগুলো দেখে তাজ্জব বনে গেলাম।  আমাদের বিশেষ মুহূর্তগুলো চট করে ছবি তুলে ফেলি। আর আগেকার মানুষ প্রকাণ্ড  আকারের পাথরের স্ল্যাব কেটে, চেঁছে, খোদাই করে ছবি বানিয়ে রাখত! ৮ম শতাব্দীর রাজা ইয়ারিরি, ভবিষ্যত রাজা তার ছোটো ভাই কামিনির কব্জি ধরে হাঁটছে৷ তাদের হাতে তলোয়ার আর রাজার রাজদণ্ড। এরকম আরও অনেক অর্থো-স্ট্যাট ছিল। সবগুলো অর্থবহ। যে সকল ভাস্কর রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে হাতে ফোসকা ফেলে এরকম অজস্র অর্থো-স্ট্যাট বানিয়েছে তারা কি কস্মিনকালেও ভেবেছিলো তাদের তৈরি মাস্টারপিসগুলো হাজার বছর পরের মানুষ দেখতে পাবে আর তাদের তারিফ করবে! খুব অন্যরকম লাগছিল। সৃজনশীল মানুষেরা শুরু থেকেই তাক লাগাতে ওস্তাদ। ধীরেধীরে সব পড়ছিলাম। মানুষ বরাবরই স্মৃতি ধরে রাখতে ভালোবাসে। তারই নমুনা এগুলো।

আরও দেখেছি রোমানদের চিকিৎসা সরঞ্জাম। সাথে ছিল ওদের কাচের তৈরি জিনিস। অভিনব প্রক্রিয়ায় তারা কাচ গলিয়ে তাতে প্রয়োজন মতো আকার দিতে জানত।

খ্রিষ্টপূর্ব ১ম শতকের দিককার কবর দেওয়ার ব্যাবস্থা দেখে ভয়ে শিউরে উঠেছিলাম। আলো-আঁধারের একটা ভয়ানক ভাবসাব ছিল সে ঘরটায়। জাদুঘর শেষ হয়েছে মুসলিম খলিফাদের আমলের মুদ্রা-মেডেলসহ আরও কিছু সংগ্রহ দিয়ে। 

শুরুতে বলেছিলাম, একটি জাদুঘর একটি বইয়ের সমান। গাজিয়ান্তেপের আর্কিওলজি জাদুঘর নিয়ে বই লিখলে সে বই হবে  অনেক বড়ো। সব লেখা মনে হয় না এ জীবনে লেখা সম্ভব । শেষে ছোটো করে যদি অনুভূতি বলি তো বলব, আগাগোড়াই মনে হচ্ছিলো যেন টাইম ট্রাভেল করছি! আলোর বাড়াবাড়ি নেই, কিন্তু সব ফলকগুলো পড়া যাচ্ছিল। সত্যি বলতে ভেবেই কুল পাচ্ছিলাম না, এত হাজার-হাজার বছরের পুরাতন বৈচিত্র্যময় শিল্প, কিছু অক্ষত আবার কিছু একটু ধ্বংসপ্রাপ্ত,  সবগুলোকে এক ছাদের নিচে গুছিয়ে রাখতে কতটা ব্রেইন স্টর্মিং! কতটা সময় আর শ্রম খরচা গিয়েছে এর পেছনে কে জানে! বের হয়ে এসেও যেন তৃষ্ণা মিটেনি। তাই সময় করে অবশ্যই আরেকবার গিয়ে ঘুরে আসব এ জাদুঘর থেকে।

Related Articles

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

0FansLike
0FollowersFollow
0SubscribersSubscribe
- Advertisement -spot_img

Latest Articles